বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঘাড়ে ‘মানুষখেকো’ গুজবের খড়্‌গ

  •    
  • ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ২১:৪৪

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ফটোকার্ড ও ভিডিওসহ নানা ধরনের কনটেন্টে দাবি করা হচ্ছে- কলেজছাত্র শিবলিকে হত্যার পর অভিযুক্তরা তার ‘মাংস রান্না করে খেয়েছে’। একইসঙ্গে ‘মানুষখেকো’ আখ্যা দিয়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে। এতে করে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।

চট্টগ্রামের রাউজানে এক কলেজছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নানামুখী গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলোতে ভর করে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে বানায়োট গল্প, ফটোকার্ড ও ভিডিওসহ নানা ধরনের কনটেন্ট ফেসবুক-টিকটকের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ফটোকার্ড ও ভিডিওসহ নানা ধরনের কনটেন্টে দাবি করা হচ্ছে- ওই কলেজছাত্রকে হত্যার পর অভিযুক্তরা তার ‘মাংস রান্না করে খেয়েছে’। একইসঙ্গে পাহাড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে ‘মানুষখেকো’ আখ্যা দিয়ে এই জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষমূলক নানা বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া এসব গুজব ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা বিব্রতকর পরিস্থিতি ও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

শুধু তাই নয়, এ ধরনের গুজব ও পাহাড়ে বসবাসকারী গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর ফলে এই অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে- এটা কি নিতান্তই গুজব? নাকি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে এটা সৃষ্টি করেছে এবং বিরামহীন ‘জ্বালানি’ সরবরাহ করে চলেছে?

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের হেনস্তার অভিযোগ

দৈবভাবে পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৭ জন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাদের মধ্যে ৫ জন অবাধ চলাচল করতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিদ্বেষমূলক এই গুজবের ফলে কোনো না কোনো সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

তাদের একজন চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করা নীলা চাকমা। তিনি জানান, কাজের সুবাদে তাকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে থাকতে হয়। রাউজানের ওই কলেজছাত্র খুনের পর শহরে বসবাস করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে বলে দাবি তার।

নীলা চাকমা বলেন, ‘নিজ এলাকার বাইরে ভাষাসহ নানা কারণে আমরা বুলিংয়ের শিকার হই। এখন মানুষের মাংস খাওয়ার আরেকটা ট্যাগ যুক্ত হলো। এই যে রিকশাওয়ালা মামা, সবজিওয়ালা, দোকানদাররা বলতেছে, আমি খুবই অনিরাপত্তায় ভুগছি।

‘কয়েকদিন আগে আমি এক বান্ধবীর সঙ্গে নগরীর অক্সিজেন এলাকায় অনন্যা আবাসিকে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে একজন আমাকে আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করেছে। প্রতিবাদ করায় ওই ব্যক্তি আমার সঙ্গে বাদানুবাদে মানুষের মাংস খাওয়ার বিষয় টেনে আনেন।’

তিনি আরও বলেন, “সামসাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো থাকতেই পারছি না। নিউজফিডে ২০টি নিউজ থাকলে তার মধ্যে ১০টিই আমাদের প্রতি বিদ্বেষমূলক। মেসেঞ্জারে বন্ধুরা বলতেছে- ‘তোরা তো এই খাস; তোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যাবে না।’ এমনকি গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট মানুষও আছে এই তালিকায়।”

আরেক ভুক্তভোগী অভি চাকমা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘রাউজানের ওই ঘটনার পর যখন ফেসবুকে আমরা মানুষের মাংস খাই বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, এর কয়েকদিন পর ক্লাস থেকে ফেরার পথে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের দিকে দুই তরুণীর সঙ্গে দেখা। তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই মনে হয়েছে। ওরা আমাদের দেখে এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে যেন আমরা বোধহয় জ্যান্ত মানুষ খেয়ে ফেলি।

‘আবার নিজেদের মধ্যেও বলাবলি করছিল- রাউজানের ওই ঘটনার পর পাহাড়ি দেখলেই ভয় লাগে। কথাটা আমি শুনে ফেলায় ওদেরকে বলেছি, কয়েকজন অপরাধ করলেই সেই দায় পুরো জনগোষ্ঠীর হতে পারে না। তাছাড়া মানুষের মাংস খাওয়ার বিষয়টিও গুজব।’

চট্টগ্রাম শহরে কর্মক্ষেত্রে হেনস্তার শিকার স্বপন চাকমা নামের আরও একজনের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। শহরের বায়েজিদ বোস্তামি এলাকার কনডেন্সড মিল্ক উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি৷

নিউজবাংলাকে স্বপন বলেন, “ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার সময় রাস্তাঘাটে মানুষজন আমাদের দেখলে বলে, ‘তোমাদের চাকমারা নাকি মানুষের মাংস খায়?’ এমনকি ফ্যাক্টরির ভেতর আমাদের সুপারভাইজারও প্রশ্নের সুরে বলেন- তোমরা চাকমারা নাকি মানুষের মাংস খাও। তখন স্বাভাবিকভাবেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।”

গুজবটা যেভাবে ছড়ালো

ঘটনার শুরু ১১ সেপ্টেম্বর। ওইদিন রাঙামাটি জেলার কাউখালী ইউনিয়নের দুর্গম বালু পাহাড় এলাকা থেকে এক কলেজ শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত শিবলি সাদিক রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চপাড়ার মুহাম্মদ শফির ছেলে। কদলপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্থানীয় একটি মুরগির খামারে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। মরদেহ উদ্ধারের ১৪ দিন আগে ওই খামার থেকে অপহরণ করা হয়েছিল তাকে।

পুলিশ জানায়, শিবলির সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে আরো ৬ জন কাজ করত। তারা সবাই পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য। ঘটনার মাসখানেক আগে তাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় শিবলির। খামার মালিক সে সময় ঘটনাটি মিমাংসা করে দিলেও ক্ষুব্ধ ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শ্রমিকরা। সেই ক্ষোভ থেকে ২৭ আগস্ট রাতে শিবলিকে অপহরণ করে আট কিলোমিটার দূরের গহীন পাহাড়ে নিয়ে যায় তারা।

পরবর্তীতে স্বজনদের ফোন করে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। এক পর্যায়ে ১ সেপ্টেম্বর শিবলির বাবা শফি গিয়ে বান্দরবানে অপহরণকারীদের কথামতো দুই ব্যক্তিকে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আসেন। এর আগে ৩১ আগস্ট সবশেষ তাদের সঙ্গে শিবলির কথা বলিয়ে দেয় অপহরণকারীরা।

‘ছেড়ে দেয়া হয়েছে, বাসায় চলে যাবে’- মুক্তিপণ পাওয়ার পর অপহরণকারীরা স্বজনদের আশ্বাস দিলেও বাসায় ফেরেননি শিবলি। এ ঘটনায় ৭ সেপ্টেম্বর রাউজান থানায় মামলা করেন স্বজনরা। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুইচিংমং মারমা ও অংথুইমং মারমা নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে উমংচিং মারমা নামে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১১ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির কাউখালী ইউনিয়নের দুর্গম বালু পাহাড় এলাকা থেকে শিবলি সাদিকের দেহাবশেষ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহ নিয়ে ফেরার পথে উমংচিং মারমাকে পুলিশ হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে উত্তেজিত জনতা।

গুজবের শুরু

মরদেহ উদ্ধার ও একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনার পরপরই নিহত শিবলির দেহাবশেষের ছবি এবং অভিযুক্তদের যৌথ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ছবির ক্যাপশনে দাবি করা হয়- ‘হত্যাকারীরা শিবলিকে হত্যার পর তার মাংস রান্না করে খেয়ে হাড়গোড় পাহাড়ে ফেলে দিয়েছে।’

কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের অনেকেই এই গুজবের ওপর ভিত্তি করে ভিডিও তৈরি করে ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শেয়ার করতে থাকে। কেউ কেউ ফটোকার্ড তৈরি করেও তা শেয়ার করে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে শুধু ফেসবুক ও ইউটিউবে অধিকতর অনুসন্ধান পদ্ধতিতে (অ্যাডভান্স সার্স সিস্টেম) যাচাই করে এই গুজব ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো সংক্রান্ত সহস্রাধিক পোস্টের সন্ধান পেয়েছেন এই প্রতিবেদক। এসব পোস্টের মধ্যে অধিকাংশের বক্তব্য আপত্তিকর হওয়ায় এই প্রতিবেদনে যুক্ত করা যায়নি।

আওয়ামী লীগ নেতার দাবি, ঘটনা সত্য

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। গুজবটি এত দ্রুত ছড়িয়েছে যে দায়িত্বশীল অনেকেই বিশ্বাস করে তা নিয়ে কথা বলেছেন।

বাস্তবেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলেছে দাবি করেছেন রাঙামাটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুসা মাতব্বর। তার বক্তব্যের একটি ভিডিও ইতোমধ্যে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ১ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের ওই বক্তব্যের প্রথম অংশে তিনি রাউজানে খুনের শিকার এক কিশোরের মাংস রান্না করে খাওয়ার অভিযোগ করেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে প্রথম ৪৩ সেকেণ্ডে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘গত দুই-তিনদিন আগে রাউজানের একটি ছেলেকে অপহরণ করে রাঙ্গামাটির কাউখালিতে এনে তার মাংস পর্যন্ত তারা কেটেকুটে রান্না করে খেয়েছে। এটা দুঃখজনক রাঙ্গামাটিবাসীর জন্য। এ ধরনের ঘটনা যেন পরবর্তীতে আর না ঘটে, আমরা আবেদন জানাব সরকারের কাছে। এগুলো, এই হত্যাকাণ্ডগুলো আসলে মানুষ কোনো অবস্থাতে, যে কোনো মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। সবাইকে বলব, এই ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ- মানুষের মাংস রান্না করে খাওয়া, এটা কত বড় অপরাধ! আমি বলার, মুখের ভাষাই পাচ্ছি না, কী বলব আমি!’

পরের ১ মিনিটে পাহাড়ে অস্ত্রধারীদের কাছ থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন তিনি।

অবশ্য বক্তব্যের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি। ব্যস্ততার অজুহাত তুলে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতেও রাজি হননি তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটি প্রথম প্রকাশ করে ‘সম্প্রীতির রাঙ্গামাটি’ নামের এক ফেসবুক পেজ। এই ফেসবুক পেজের মালিক ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি অবজারভারের রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি শেখ ইমতিয়াজ কামাল ইমন।

১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে ইমনের সঙ্গে কথা বলে নিউজবাংলা। তিনি বলেন, ‘৪ থেকে ৫ দিন আগে নির্বাচন নিয়ে আমরা চার থেকে পাঁচটা গণমাধ্যম ওনার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আমাদের মধ্যে একজন ওনাকে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করলে ওনি এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমার কাছে র-ভিডিও (মূল ভিডিও) আছে।’

মরদেহ উদ্ধারকারী পুলিশ যা বলছে

শিবলি সাদিক হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। তাদের মধ্যে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে তিন জন। তবে তাদের কেউই শিবলির মাংস রান্না করে খাওয়ার বিষয়ে কিছু বলেনি বলে দাবি পুলিশের।

মরদেহ উদ্ধার ও আসামিদের গ্রেপ্তারের অভিযানিক দলে ছিলেন রাউজান থানার উপ-পরিদর্শক আজিজুল হক। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও তিনি।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রান্না করে তার মাংস খাওয়ার খবরটি ভুয়া। এসবের ভিত্তি নেই। এ বিষয়ে আমরা নিজেরাই তো কিছু পাইনি। ব্লগাররা ভাইরাল হওয়ার জন্য এটা ছড়াচ্ছে। এটা নিয়ে আমাদের সাইবার টিম মাঠে নামছে।

আমাদের স্যারও (ওসি) এটা নিয়ে কথা বলেছেন। যারা এসব ভুয়া নিউজ ছড়িয়ে দেশের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এই মামলায় সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরই এক মেয়ে। তিনি আমাদের একজন কনস্টেবল। যেহেতু ভাষার একটা সমস্যা আছে, আমরা ওর সহযোগিতায় কাজগুলো করছি।’

প্রায় একই কথা বলেন রাউজান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ছিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘হত্যায় জড়িতরা নিহতের মাংস রান্না করে খেয়েছে- এরকম কোনো তথ্য আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। যারা এগুলো ছড়াচ্ছে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে যে তারা এসব তথ্য কোথায় পেলেন!’

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অপহরণের ১৪ দিন পর আমরা দেহাবশেষ পেয়েছি। যে এলাকা থেকে দেহাবশেষ উদ্ধার করেছি, এর আশপাশের ৮ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাড়িঘর নেই।

‘জায়গাটি পাহাড়ি গভীর জঙ্গল এলাকা। জনবসতিশূন্য এই জঙ্গলে বিভিন্ন প্রাণী থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। সেসব প্রাণী মরদেহের অংশবিশেষ খেয়ে থাকতে পারে।’

‘আমরা তো জানি যে, মানুষের মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে মরদেহের পচন শুরু হয়। মরদেহটি পাওয়া গেছে হত্যার ৮ থেকে ১০ তিন পর। তাই আমাদের ধারণা, শেয়াল বা অন্য কোনো প্রাণী মরদেহ খেয়ে ফেলেছে, নয়তো পচে গেছে।’ যোগ করেন তিনি।

তবে জবানবন্দি দেয়া তিনজনের একজন ওই এলাকায় একদিন রাতে মুরগির মাংস ও ভাত রান্না করে খাওয়ার কথা জানিয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, ‘যেহেতু তারা সেখানে ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই মুরগি-ভাত রান্না করে তারা এক রাতে খেয়েছে।’

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যা বললেন

পুলিশ ও নিহতের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সবশেষ ৩১ আগস্ট পরিবারের সঙ্গে শিবলি সাদিকের কথা বলিয়ে দিয়েছে অপহরণকারীরা। এর পরপরই তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। এরপর মরদেহ উদ্ধার করা হয় ১১ সেপ্টেম্বর। মাঝে ১১ থেকে ১২ দিন মরদেহটি গভীর পাহাড়ি জঙ্গলেই ছিল।

সাধারণত মরদেহে পচন শুরু হয় পরিবেশ, তাপমাত্রা, ঋতু, মরদেহের ধরনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে।

রাঙ্গামাটির ওই পাহাড়ি গভীর জঙ্গলে ১০ থেকে ১২ দিনে একটা মরদেহের কী অবস্থা হতে পারে তা জানতে চাওয়া হয় ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. কাশেমের কাছে। তিনি বলেন, ‘মরদেহের মাংস পচে যাবে। কিছু মাংসসহ হাড় অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিছু মাংস শরীরে সংযুক্ত থাকতে পারে।’

তবে গভীর জঙ্গলে একটা মরদেহ পড়ে থাকলে বিভিন্ন প্রাণী তা খেয়ে ফেলতে পারে বলে ধারণা তার।

ডা. কাশেম আরও বলেন, ‘বিভিন্ন প্রাণী মরদেহের বিভিন্ন অংশ খেয়ে ফেলতে পারে। তবে তা কোনো প্রাণী খেয়েছে নাকি কোনো অস্ত্র দিয়ে কাটা হয়েছে তা জানতে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে মরদেহ পরীক্ষা করতে হবে। মোটামুটি পচে গেলেও তিনি এ বিষয়ে বলতে পারবেন।’

রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র বলছেন মানবাধিকার কর্মীরা

বর্তমানে দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। তাদের অধিকাংশেরই বাস পার্বত্য চট্টগ্রামে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ‘মানুষের মাংস খাওয়া’ গুজবকে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।

মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘এটা একটা সাম্প্রদায়িক উষ্কানি ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র। এটা যারা করছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এই অপতৎপরতায় নিরীহ লোকজন হয়রানির শিকার হচ্ছে। একটা সম্প্রদায়কে টার্গেট করে এভাবে গুজব ছড়ানো একটা গভীর চক্রান্ত বলে মনে হচ্ছে। যে যা-ই করুক, অতীতেও এই অঞ্চলে শান্তি নষ্টের চেষ্টা করেছে, পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না ইনশাআল্লাহ।’

মাঠে নামছে সাইবার পুলিশ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের গুজব যারা ছড়িয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনার কথা জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার পুলিশ সেন্টার) খন্দকার তৌহিদ হাসান। তিনি বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা হলে আমরা সাধারণত বিটিআরসির মাধ্যমে এ ধরনের গুজবের লিংকগুলো বন্ধ করে দেই। তাছাড়া এ ধরনের গুজব ছড়ানোর পেছনে যারা জড়িত তাদেরও শনাক্ত করা হবে। শনাক্তের পর সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর