বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

খাল ভরাটে সড়কে জলাবদ্ধতা, অবৈধ সংযোগের তারে বিদ্যুতায়িত পানি

  •    
  • ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ২৩:২৫

সড়কটির পাশে খাল ভরাট করায় বৃষ্টি হলেই ওই এলাকায় পানি আটকে থাকে। জলাবদ্ধ হয়ে থাকে পুরো এলাকা। আর যে বিদ্যুতের লাইনের লিকেজ তার এই পানিতে পড়ে পানি বিদ্যুতায়িত হয়েছে, সেই বিদ্যুতের সংযোগই অবৈধ।

রাজধানীর মিরপুর কমার্স কলেজসংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে হাজী রোডে বি ব্লকের মুক্তা ফার্মেসির সামনে বৃষ্টির পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। অবৈধভাবে নেয়া বিদ্যুৎ সংযোগের লিকেজ থেকে এ সড়কে জমে থাকা পানি বিদ্যুতায়িত হওয়ার খবর হয়তো জানতেন না এদের কেউই। তবে যারা সেখানকার স্থানীয়, তারা অনেক দিন ধরেই ধারণা করতেন এমন বড় বিপদের।

সড়কটির পাশে খাল ভরাট করায় বৃষ্টি হলেই ওই এলাকায় পানি আটকে থাকে। জলাবদ্ধ হয়ে থাকে পুরো এলাকা। আর যে বিদ্যুতের লাইনের লিকেজ তার এই পানিতে পড়ে পানি বিদ্যুতায়িত হয়েছে, সেই বিদ্যুতের সংযোগই অবৈধ।

বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীতে মুষলধারে বৃষ্টিতে পানি জমে যায় অনেক সড়কে। এর মধ্যে একটি হলো মিরপুরের ওই এলাকা। রাত ১০টার দিকে ওই সড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান ৩০ বছরের মো. মিজান, তার স্ত্রী ২৫ বছরের মুক্তা বেগম, মেয়ে ৭ বছরের লিমা। তাদের বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছ ২০ বছর বয়সী মো. অনিকের। তবে পানি থেকে উদ্ধার করা মিজানের ৭ মাস বয়সী ছেলে হোসাইন প্রাণে বেঁচে গেছে।

নিউজবাংলার অনুসন্ধানে এই চারজনের মৃত্যুর জন্য দুটি কারণ পাওয়া যায়। একটি বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ও অন্যটি খাল ভরাট।

অবৈধভাবে নেয়া সংযোগের তার লিকেজ বেরিয়ে এসেছে ড্রেন দিয়ে । ছবি: নিউজবাংলা

অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঝিলপাড় বস্তির সামনে ও হাজী রোডের পেছনে মিরপর-২ ডুইপ আবাসিক এলাকার বি ব্লকের দুই নম্বর রোডে থাকা বিদ্যুতের পিলার থেকে ওই বস্তির অবৈধ বিদ্যুতের লাইন নেয়া হয়েছে। যে দুটি পিলার থেকে এই অবৈধ সংযোগ নেয়া হয়েছে, সেখানে গিয়ে সংযোগের তার কাটা অবস্থায় দেখা যায়। এই দুই পিলারের একটির অবস্থান মুক্ত ফার্মেসি ভবনের পেছনে।

মুক্তা ফার্মেসির ভবনের লাগোয়া সিরাজিয়া ইসলামিয়া মাদরাসার ছাদ দিয়ে লাইন টানা হয়েছে। এই লাইন ভবনের দেয়াল দিয়ে নামানো হয়েছে ভবনের সামনের ড্রেনে। কেউ যাতে না বুঝতে পারে এই কারণে মাদরাসার ছাদে ও ভবনের যে দেয়াল দিয়ে তার টানা হয়েছে; এই অংশ সিমেন্ট-বালু দিয়ে প্লাস্টার করে ঢাকা হয়েছে। এই প্লাস্টারের ভেতর দিয়ে এখনো তার দেখা যাচ্ছে।

প্লাস্টার পার হয়ে সামনের ড্রেনের ভেতর দিয়ে বস্তিতে তার টানা হয়েছে। ড্রেনের ভেতরের তার কসটেপ দিয়ে পেঁচানো হয়েছে। আর এই তারের লিকেজেই বিদ্যুতায়িত হয় সড়কের পানি, যাতে হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

মুক্তা ফার্মেসি ও ভবনটির মালিক জসিম উদ্দিন পাটোয়ারী। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীও তিনি।

চোরাই লাইনের বিষয়ে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের চোরাই লাইনগুলো আমার বাসার পেছনে ডুইপ আবাসিক এলাকার বি ব্লকের দুই নম্বর রোডের পিলার থেকে নেয়া হয়েছে। অধিক লোডের কারণে এই পিলারে মাঝে মাঝেই আগুন জলে ওঠে। পিলার থেকে লাইন টেনে আমার ভবনের লাগোয়া সিরাজিয়া ইসলামিয়া মাদরাসার ছাদ দিয়ে লাইন টানা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের অবৈধ লাইন টানার স্থান দিয়ে প্লাস্টার করে বিদ্যুতের লাইন ঢাকা হয়েছে। বস্তিবাসী মাঝে মাঝে গভীর রাতে প্লাস্টার ভেঙে লাইন ঠিক করে। আমার ছোট মেয়ে অসুস্থ। প্লাস্টার ভাঙার শব্দ ও পিলারে আগুন জলার কারণে আমার অসুস্থ ছোট মেয়ে ভয় পায়। তাই তাকে তার বড় বোনের বাসায় রেখেছি।’

জসিম উদ্দিন বলেন, ‘অবৈধ বিদ্যুতের লাইনের জন্য আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। কখন যে আগুন লেগে আমার বাসা পুড়ে যায়।’

ঝিলপাড় বস্তিতে যেসব বাসা ভাড়া দেয়া হয়, তার সঙ্গে বিদ্যুৎ বিলও যুক্ত করা হয়। এ কারণে যারা বাসা ভাড়া দেন তাদের বেশিরভাগই বিদ্যুতের চোরাই লাইন ব্যবহার করেন। অবশ্য এই বস্তিতে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) কিছু প্রিপেইড মিটার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এক মিটার থেকে একাধিক বাসায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া আছে।

খাল দখল করে স্থাপনা। ছবি: নিউজবাংলা

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বস্তির একাধিক ব্যক্তি নিউজবাংলাকে বলেন, যারা বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন তারা ডেসকোর সঙ্গে যোগসাজসে বিদ্যুতের চোরাই লাইন বস্তিতে সংযোগ করেছেন। প্রতিমাসে ডেসকোর লোকজন চোরাই লাইন বাবদ টাকা নিয়ে থাকেন।

নিহত অনিকের মামা মোক্তার হোসেন বলেন, ‘ডেস্কোর লোকজন চাইলেই চোরাই লাইন বন্ধ করতে পারে। তারা করবে না। কেন করবে না সেটা আপনারা জানেন। ডেসকোর কাছে একটাই চাওয়া এরকম দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে।’

বস্তিতে বেশ কয়েকজন ঘর ভাড়া দিয়ে থাকেন। তারাই এই চোরাই লাইন ডেসকোর সহযোগিতায় চালিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর সঙ্গে লাইলি, মমিন, জাহাঙ্গীর, আলমগীর মোল্লার স্ত্রী ও শ্যালিকাসহ আরও অনেকে জড়িত বলে দাবি করে স্থানীয়রা।

যা বলছে ডেসকো

চোরাই লাইন ও বস্তির নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গে ডেসকোর কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগের বিষয়ে জানার পর ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি অবশ্যই এই বিষয়ে তথ্য নেব। আমাদের কর্মকর্তাদের বিষয়ে যে অভিযোগ এ রকম তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে চোরাই লাইন থাকতে পারে। আমরা প্রতিনিয়ত এই সব জায়গায় দিনে ও রাতে অভিযান চালাই। ’

ঝিলপাড় বস্তি এলাকায় সুষ্ঠুভাবে বিদ্যুতের লাইন দেয়া যায় না এবং ভেতরে লাইন টানা যায় না- এ কারণেই এই ধরনের ঘটনা বলে জানান এই প্রকৌশলী। এ ছাড়া চোরাই লাইন এখানে চলে বলেও স্বীকার করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কারো জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া বস্তি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কষ্টকর সেটা আপনারা জানেন। তবে প্রতিনিয়ত ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে ও টিম পাঠিয়ে আমরা তদারকি করছি।’

মিরপর-২ ডুইপ আবাসিক এলাকার বি ব্লকের দুই নম্বর রোডের পিলার থেকে যে বিদ্যুতের অবৈধ লাইন টানা হয়েছে, এটা কি এতদিন জানতেন- এমন প্রশ্নে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমি নিজে তো আর দেখি নাই। আমরা প্রতিনিয়ত টিম পাঠিয়ে তার কেটে নিয়ে আসি। প্রতি দিন তো আর যাওয়া হয় না।

‘সপ্তাহে একবার গিয়ে তার কেটে নিয়ে আসে। যখন কেটে নিয়ে আসি, তার পর আবার একই অবস্থা। এই ধরনের কাজে আমরা যাদের নাম পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছি।’

যারা অবৈধ লাইন টানেন তাদের কাউকে কি আপনারা এখনো আইনের আওতায় আনতে পেরেছেন- এমন প্রশ্নে এই প্রকৌশলী কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

তিনি বলেন, ‘আমরা চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় একটা তদন্ত কমিটি করবো। আমাদের পক্ষ থেকে যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার আমরা সেটা করবো।’

কান্নায় ভেঙে পড়েন মুক্তার মা। ছবি: নিউজবাংলা

খাল ভরাট

ঝিলপাড় বস্তি ও সামনের হাজী রোড ঢালু এলাকা। বৃষ্টিতে মিরপুর-২ এলাকার পানি গড়িয়ে এই হাজী রোডে নামে। ৩/৪ বছর আগে এই পানি ঝিলপাড় বস্তির পূর্ব পাশে থাকা ৪০ ফিট প্রশস্ত খাল দিয়ে চলে যেত। এতে এই এলাকা ও বস্তিতে জলাবদ্ধতা হতো না।

তবে দুই থেকে তিন বছর ধরে এই খাল ভরাট করা হয়েছে। ৮-৯ মাস আগে বস্তির পেছনে থাকা দারুল আমান গৃহ নির্মাণ সমিতি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ খালটি ভরাট করে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। মসজিদের সামনের অংশের কাজ এখনো চলমান।

অভিযোগ আছে, এই মসজিদে দারুল আমান গৃহ নির্মাণ সমিতি লিমিটেডের আওতায় থাকা ভবনের মানুষ ছাড়া বস্তিবাসীদের নামাজ আদায় করতে দেয়া হয় না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বস্তির একাধিক বাসিন্দা নিউজবাংলাকে বলেন, খালটা যখন চালু ছিল তখন মিরপুর-২ নম্বর এলাকা থেকে যে পানি আসতো এই পানি খাল দিয়ে চলে যেত। বস্তির পেছনে একটি ঝিল এখনো আছে। খাল দিয়ে এই ঝিল হয়ে পানি চলে যেত। কিন্তু ২-৩ বছর ধরে এই খাল ভরাট করেছে দারুল আমান গৃহ নির্মাণ সমিতি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ। আর ৮ মাস আগে মসজিদ নির্মাণ করেছে তারা।

স্থানীয়রা বলেন, ৪০ ফিট প্রস্থের এই খালের ওপরে মসজিদ বানিয়ে খাল দখল করা হয়েছে। আমরা বস্তির লোকজন মিলে খাল দখল করার সময় অনেক বাধা দিয়েছিলাম।

খাল দিয়ে পানি মেশার কথা এই স্থানে, অথচ তা আটেকে যায় সড়কে। ছবি: নিউজবাংলা

বস্তিবাসীরা অভিযোগ করে বলেন, খালটা বন্ধ না করলে রাস্তায় পানি জমতো না। আর পানি না জমলে চারটা মানুষকে মরতে হতো না।

এই হাউজিং ঘুরে এবং কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এখানকার হাউজিং কর্তৃপক্ষের কারও ফোন নম্বর পাওয়া যায়নি।

দারুল আমান গৃহ নির্মাণ সমিতির সিকিউটিদের প্রধান মো. সামসুলের কাছে এই হাউজিংয়ের কর্তৃপক্ষের নম্বর চাইলে তিনি বলেন, ‘এই হাউজিংয়ে নতুন কমিটি হয়েছে। কারও নম্বর আমার কাছে নাই।’

খাল ভরাটের বিষয় ‘জানত না’ সিটি করপোরেশন

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. সেলিম রেজা জানান, খাল ভরাটের বিষয়টি সিটি করপোরেশন জানত না।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটা কয়েকটা ঘটনার সমাহার। ডেসকোর অবৈধ বিদ্যুতের লাইন মাদরাসার ভেতর দিয়ে নিয়েছে। এই তার সেখানে পড়ে ছিল। তা ছাড়া এখানে পানি প্রবাহ ডায়ভার্ট করা হয়েছে। খাল দখল করে মসজিদ তৈরি করেছে। মসজিদ রাতারাতি ভেঙে দেয়া যায় না।

‘আমাদের কাছে খাল দখল করে মসজিদ বানানোর বিষয়ে কেউ অভিযোগ দেয়নি। আমাদের অবগত করলে আমরা এলাউ করতাম না। লোকালি কারা কারা জড়িত এই খাল দখলে সেটা খতিয়ে দেখা হবে।’

খাল দখলের সময় বস্তিবাসী বিক্ষোভ করেছে- এমন প্রশ্নে সেলিম রেজা বলেন, ‘খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে অভিযোগের বিষয়তা কতটুকু ঠিক।’

২/৩ বছর ধরে খাল দখল করা হয়েছে। এটা তো রাতারাতি হয় নাই। এটা তো দেখভালের দায়িত্ব আপনাদের। উত্তরে তিনি বলেন, ঢাকা শহরের অনেক খাল ভরাট হয়ে গেছে। এই খাল কারা ভরাট করেছে, কিভাবে ভরাট করেছে, কেন উদ্ধার হয় নাই এটার জন্য যারা দাতিত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাদেরকে এর জবাব দিতে হবে।

এই এলাকার সিটি কর্পোরেশনের জনপ্রতিনিধি তার এলাকার খাল ভরাটের খবর রাখেন না, নাকি তিনিই জড়িত- এমন প্রশ্নের উত্তরে সেলিম রেজা বলে, এটা আমার নলেজে নাই। যাদের এই খাল ভরাটের বিষয়টি আমাদের নলেজে আনার কথা তারা নলেজে না আনলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

যাদের দায়িত্ব তারা আপনাকে জানালে অবশ্যই আপনি এই খাল ভরাটের বিষয়টি জানতে পারতেন, কিন্তু তারা আপনাকে তা জানায়নি- এমন প্রশ্নে সেলিম রেজা বলেন, ‘এটা তদন্ত করে দেখবো। কেউ এটার দায় এড়াতে পারবে না। মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে আলাপ করে আমরা তদন্ত কমিটি করবো।’

অবৈধভাবে নেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। ছবি: নিউজবাংলা

কেমন আছে হোসাইন

শুক্রবার দুপুরে বস্তির ভেতরে একটি টিনশেড ও আধাপাকা বাসার দোতলায় গিয়ে এক নারীর কোলে দেখা যায় বাবা-মা-বোন হারানো হোসাইনকে। ওই নারীকে হোসাইনকে চামচে করে পানি খাওয়াচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ডাক্তার প্রচুর পানি খাওয়াতে বলেছে।’

এ সময় হোসাইন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠতে থাকে। শিশুটিকে দেখে মনে হচ্ছিল সে তার মায়ের কোল চাচ্ছে। কিন্তু তার মা, বাবা ও বোন তখন মর্গের ফ্রিজে। হোসাইনকে ঘিরে ছিল অনেকেই। সবাই তার কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সে থামছেই না। হোসাইনের কান্না শুনতে শুনতেই এই প্রতিবেদক ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

শিশু হোসাইন শুধু কাঁদছে। ছবি: নিউজবাংলা

মুক্তার মায়ের বাসায় বেড়াতে এসে মৃত্যু

বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যাওয়া মুক্তার মা কুলসুম বেগম কাঁদতে কাঁদতে চুপ হয়ে গেছেন। কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। তিনি নিজেও অসুস্থ। কিছুক্ষণ পর পর কেঁদে উঠছেন। তাকে বস্তির অন্য নারীরা সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কুলসুম বেগম তার স্বামী ও দুই বাচ্চাসহ বস্তিতে থাকেন।

পরে কথা হয় কুলসুম বেগমের প্রতিবেশী এবং ঘটনাস্থলের বিপরীত পাশে বস্তির সামনে গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানি ও তার স্ত্রী লাবনীর সঙ্গে। তাদের সঙ্গেই শেষ কথা হয় মুক্তা ও তার স্বামীর।

লাবনী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তা তার স্বামী ও দুই সন্তানসহ বুধবার গ্রাম থেকে ঢাকায় আসে। মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্সের পাশে তাদের বাসা। মুক্তার মা বাবা থাকে ঝিলপাড় বস্তিতে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় মুক্তা তার পরিবার নিয়ে বস্তিতে তার মায়ের বাসায় আসে। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে বৃষ্টির মধ্যেই তারা বের হয়। আমার স্বামীকে যাওয়ার সময় সালাম দেয় মুক্তা ও তার স্বামী মিজান। পরে খোঁজ খবর নিয়ে মিজান বলে, কাকা যাই গা। পরে রাস্তায় ওই পারে চলে যায়।’

তিনি বলেন, ‘মুক্তার মা ৫০ টাকা দিয়ে বলেছিল রিকশা দিয়ে যেও। এর কিছুক্ষণ পরই এই ঘটনা। পরে বাচ্চাটাকে একজন পানি থেকে টেনে তুলে একজনের হাতে দেয়। পরে ছোট বাচ্চাটা বাঁচছে। মিজান ফুচকা ও ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন। মিজানের বাড়ি বরিশাল। মুক্তার বাড়ি ভোলা।’

মৃত্যুর এক দিন আগেই বিবাহবিচ্ছেদ হয় অনিকের

অনিক অটোরিকশাচালক ছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে বৃষ্টি শুরু হলে কমার্স কলেজসংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে একটি দোকানের সামনে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। বৃষ্টির কারণে সেখানকার রাস্তা তলিয়ে যায়। মৃত্যুর ফাঁদ ওয়ে ওঠা সড়কটিতে মিজান-মুক্তা দম্পতি ও সন্তানেরা বিদ্যুতায়িত হলে তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে মারা যান অনিক।

অনিকের মামা মোক্তার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনিকের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণার খালিয়াজুড়ি উপজেলার সাতগাঁও গ্রামে। এক বছর আগে অনিক বিয়ে করেছিল। বুধবার বিকেলেই অনিকের স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। আর বৃহস্পতিবার রাতে সে মারা গেল। ঢাকাতে সে একাই থাকত। ’

মামলা ও পুলিশের ভাষ্য

অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ করে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিহত অনিকের বাবা বাবুল মিয়া মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি নিজে ঘটনাস্থলে গিয়ে সব তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। রাত থেকেই বিষয়টা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। বিকেলে মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে তাদের পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ঘটনায় যার-ই দায় পাওয়া যাবে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর