অডিট আপত্তি সমন্বয়ে ঢাকায় পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের ঘুষ দিতে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের কর্মচারীর নামে চেক ইস্যু করা হয়েছে বলে নিউজবাংলাকে জানিয়েছে দায়িত্বশীল একটি সূত্র।
ওই সূত্রটি জানায়, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে ঘুষ দিতে চট্টগ্রাম বোর্ডের হিসাব শাখা থেকে উত্তোলনের জন্য চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর নামে দেড় লাখ টাকার চেক ইস্যু করা হয়েছে।
চেকটি নগদায়নের পর তিন কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি দল গত রোববার ঢাকায় গেছে জানিয়ে সূত্রটি নিউজবাংলাকে বলে, রাজধানীতে অডিট আপত্তি সমন্বয়ের নামে বোর্ডের ফান্ড থেকে উত্তোলন করা টাকার কিছু অংশ ঘুষ হিসেবে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হস্তান্তরের কথা ছিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড হিসেবে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত নিয়োগ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বোর্ডের বিষয়ে জ্ঞাত ৯০টি অডিট আপত্তি রয়েছে, তবে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড নিয়ে অডিট আপত্তি রয়েছে ১২৫টি।
বিষয়টি সমন্বয় করতেই চট্টগ্রাম বোর্ড কর্মকর্তারা নিরীক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের উৎকোচের মাধ্যমে খুশি করার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানায় সূত্রটি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সম্প্রতি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. আশরাফুল আলমের নামে চেকটি ইস্যু করা হয়। ৬৯৪৪৭৮৯ নম্বরের ওই চেকে ‘রিকনসিলিয়েশন’ খাত দেখানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম বোর্ড সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায়, চেক নগদায়নের পর গত রোববার বোর্ডের উপপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ এমদাদ হোসাইন, সহ-হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ওসমান গনি, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আশরাফুল আলম ও অডিট কর্মকর্তা লোকমান হোসেনের ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল, তবে বিষয়টি সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত চলে আসায় বোর্ডের উপপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ এমদাদ হোসাইন ঢাকা যাওয়া স্থগিত করে বাকি তিন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পাঠান।
অডিটকে ঘিরে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সেই চাঁদার কিছু অংশ অডিটরদের আপ্যায়ন, কিছু অংশ উৎকোচ হিসেবে খরচ ও বাকি অংশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভাগাভাগি করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে, তবে অডিটরদের উৎকোচ দিতে সরাসরি বোর্ডের হিসাব বিভাগ থেকে টাকা উত্তোলনের ঘটনা এবারই প্রথম বলে জানায় সূত্রটি।
বোর্ডের এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর নামে চেক ইস্যু হওয়ার বিষয়ে হিসাব ও নিরীক্ষা শাখার উপপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ এমদাদ হোসাইন বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য যথাযথ ব্যক্তি না। এটা নিয়ে চেয়ারম্যান স্যার বা সচিব স্যারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আশরাফুল আলমের নামে ইস্যু করা চেকের অর্থ নিয়ে রোববার ঢাকা যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
নিজের নামে চেক ইস্যু, তা নগদায়ন ও ঢাকায় যাওয়ার কথা স্বীকার করেন কর্মচারী আশরাফুল আলম। তিনি বলেন, ‘চেক কার নামে হলো তা কোনো বিষয় না। মূলত দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করতে হয়। সবকিছু চেয়ারম্যান আর সচিব স্যারের নির্দেশে হয়।
‘আমরা শুধু দায়িত্ব পালন করি। আমরা ঢাকায় এসেছি, সেটাও স্যারদের নির্দেশে।’
অডিট কর্মকর্তা লোকমান হোসেন বলেন, ‘আমরা মূলত একটা মিটিংয়ে এসেছি। বোর্ডের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু অডিট আপত্তি রয়েছে। অধিদপ্তরে কী আছে আর বোর্ডে কী আছে, তা সমন্বয়ের জন্যই আমরা ঢাকায় এসেছি। এগুলো এখন ডিজিটাইজ হবে।
‘আমাদের সঙ্গে ডিডি স্যার (উপপরিচালক এমদাদ) আসার কথা, কিন্তু উনি আসেননি। এতগুলো কাজ একা করা আমার পক্ষে কঠিন। তাই আমার সঙ্গে সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ওসমান সাহেব এসেছেন। তা ছাড়া কাগজপত্র বেশি হওয়ায় তা বহনের জন্য আশরাফুল আলমকে আনা হয়েছে।’
বোর্ডের হিসাব শাখা থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আশরাফুল আলমের নামে চেক ইস্যুর মাধ্যমে উত্তোলন করা অর্থ মিটিংয়ে অ্যালাউন্স (ভাতা) হিসেবে খরচ করা হবে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক রেজাউল করিম শুরুতে রিকনসিলিয়েশন বাবদ চেক ইস্যুর বিষয়টি স্বীকার করলেও কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
তিনি বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুস্তফা কামরুল আখতারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুস্তফা কামরুল আখতারের সঙ্গে মোবাইলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং ও ভিওআইপি সার্ভিস হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠিয়েও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর নামে চেক ইস্যুর মাধ্যমে এডিটরকে উৎকোচ দেয়ার অভিযোগের বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘কোনো যথাযথ খাত থাকলে কারও না কারও নামে তো টাকাটা তুলতে হবে, সেটা বিষয় না, কিন্তু অডিটরকে দেয়ার তো এ রকম কোনো টাকা তুলতে পারবে না।
‘চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কেন, কারও নামেই চেক ইস্যু করা যাবে না। এটা তো শোভনীয় না।’