ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিজয় একাত্তর হল থেকে নিচে পড়ে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী।
ওই ছাত্র কত তলা থেকে এবং কীভাবে পড়েছেন, সেটি জানা যায়নি।
প্রাণ হারানো শিক্ষার্থীর নাম কাজী ফিরোজ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী; থাকতেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ২০৩ নম্বর কক্ষে।
প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের ছাত্র ওয়াহিদুল আলম জানান, মঙ্গলবার রাত আনুমানিক ১২টা ৫০ থেকে ৫৫ মিনিটের মধ্যে কাজী ফিরোজ একাত্তর হলের যমুনা ব্লক থেকে পড়ে যান। যেখানে তিনি পড়েছিলেন, সেই স্থানটি ছিল মাটির। তার পাশেই পাকা রাস্তা। সেখানে ছিল তার হাত।
ওয়াহিদুল বলেন, “আনুমানিক ১২টা ৫০ বা ৫৫ মিনিটে আমি বিজয় একাত্তর হলের মাঠে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলাম। এ সময় আমার চোখটা যমুনা ব্লকের দিকে ফোকাস ছিল। এ সময় আমি ‘আল্লাহরে’ বলে একটা চিৎকার শুনতে পাই। এরপর আমি সেই ব্লকের লিফটের দিকে তাকালে দেখি, উড়ন্ত লুঙ্গির মতো কিছু একটা নিচে পড়ে যাচ্ছে। এরপর অনেক বিকট একটা শব্দ হয়। বুঝলাম কেউ হয়ত লাফ দিয়েছে বা পড়ে গেছে।
“তৎক্ষণাৎ আমি সেখানে দৌড়ে যাই এবং পাশের রিডিং রুম থেকে আরও কয়েকজন ভাই দৌড়ে ঘটনাস্থলে আসে। গিয়ে দেখি, উনার শরীর ঘর্মাক্ত। সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছেন। এরপর এক ভাই উনার মুখে পানি দিয়ে বুকে পাঞ্চ করলে উনি নিশ্বাস নেয়া শুরু করে। পরে উনাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।”
এ শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘উনার পরনে একটা লুঙ্গি এবং গলায় একটা গামছা ছিল। বিজয় একাত্তর হলের শেখ রাব্বীসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী মূলত কাজী ফিরোজকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
এ বিষয়ে শেখ রাব্বী বলেন, ‘আমি রুমে শুয়ে ছিলাম। শোরগোল শুনে বের হয়ে দেখি, ‘এক ছেলে নিচে পড়ে আছে। দৌড়ে নেমে এসে দেখি, তার সেন্স নেই। এরপর তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য রিকশায় তুলে দিই। যখন তাকে আমি ধরেছি, তার শরীরটা একদম তুলতুলে হয়ে ছিল। মনে হচ্ছে সব হাড় ভেঙে গেছে, তবে তার কোনো ব্লিডিং হয়নি। আর সে সময় আমি তার বুকে হাত দিয়ে দেখেছিলাম পালস ছিল।’
যা জানিয়েছেন ফিরোজের রুমমেটরা
কাজী ফিরোজের রুমমেট ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র মাসুদ বলেন, “আমি রাত ১২টার সময় ওর বেডেই শুয়ে ছিলাম। সেও রুমে ছিল তখন। এদিক সেদিক পায়চারী করছিল। সে আমাকে বলে, ‘বন্ধু, তোর মোবাইলটা একটু দে। আমি একটা জায়গায় ফোন দিব।’ এরপর সে আমার মোবাইল নিয়ে কোনো একটা নম্বরে ফোন দেয়। একটু পরে আমাকে ফোন ফেরত দিয়ে দেয়। পরে আমি সোয়া ১২টার দিকে রুম থেকে বের হয়ে চলে আসছি।”
কাজী ফিরোজের আরেক বন্ধু আবদুল্লাহ বলেন, ‘কবি জসীমউদ্দীন হল মাঠে আনুমানিক রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। অনেক দিন পর দেখা হওয়ায় তার সাথে কুশল বিনিময় করলাম। পরে সে আমার মোবাইল নিয়ে কাকে যেন ফোন দিয়েছিল।
‘তখন তাকে ডিপ্রেসড মনে হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর সে আমার মোবাইল ফেরত দিয়ে দেয়। পরে আমি চলে আসি।’
ফিরোজের এক রুমমেট বলেন, “রাত ১০টার পরে সে রুমে আসে। তার জন্য তার টেবিলে খাবার রাখা ছিল। আমি তাকে বলি, ‘খাবার তো নষ্ট হয়ে যাবে। খাবার খেয়ে নে।’ সে বলে, ‘খামু।’ এরপর সে অজু করে এসে নামাজ পড়েছে। নামাজ শেষে সে তার টেবিলে বসল। আমরা ভেবেছি, সে হয়তো পড়তে বসেছে। এরপর আমরা রুমের লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। এরপর সে বের হয়ে যায়। এ সময় তার বেডমেট জিজ্ঞেস করল, ‘কই যাস?’ তখন সে বলে, ‘আসতেছি।’
“এর অল্প সময় পর আমরা খবর পাই, বিজয় একাত্তর হল থেকে কেউ একজন নিচে লাফ দিছে। এটা শোনার সাথে সাথে আমি লাফ দিয়ে উঠি। যেহেতু ফিরোজ শেষ কিছুদিন ধরে একটু ডিপ্রেসড ছিল, তাই আমি সবাইকে বলি, ‘ফিরোজ কই?’ দেখি, রুমে ফিরোজ নেই। এরপর আমরা সবাই দৌড় দিয়ে বিজয় একাত্তরের সামনে আসি। ততক্ষণে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আমরা হাসপাতালে এসে দেখি ফিরোজই।”
ফিরোজের বেডমেট মাসুম বিল্লাহ বলেন, “আমি লাইব্রেরি থেকে যখন রুমে আসি, এর কিছুক্ষণ পর ফিরোজ রুমে আসে। সাড়ে ১০টার দিকে সে সবাইকে বলছে, ‘তোরা কেউ আমার কাছ থেকে কোন টাকা পাস কি না বল। এমনকি দুই টাকা হলেও বল। আমি দিয়ে দিতে চাই। পেলে এখনই বল।’
“এর কিছুক্ষণ পর সে মানিব্যাগ এবং মোবাইল রেখে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি বলি, ‘কই যাচ্ছিস?’ সে বলে, ‘আমি একাত্তর হলে যাচ্ছি, একটু কাজে।’ এরপর আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।”
মাসুম বলেন, ‘তার জন্য রাখা খাবারটা সে অল্প একটু খেয়েছে। বেশির ভাগ খাবারই সে রেখে দিয়েছিল।’
সার্বিক বিষয়ে রমনা জোনের এডিসি শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সংবাদ পেয়েছি জিয়া হলের এই শিক্ষার্থী ছাদ থেকে পড়ে গেছেন। এরপর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
‘আমরা এই শিক্ষার্থীর মরদেহ সুরতহাল করে মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ নির্ণয় করার চেষ্টা করছি।’