প্রায় ১০ বছর পরিত্যক্ত থাকার পর অবশেষে পুরোনো রূপে ফিরছে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সারদাস্মৃতি ভবন।
বুধবার বিকেলে সারদা হলের সংস্কারকাজ পরিদর্শন করেন সিলেটে সিটি করপোরেশন (সিসিক) মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
এ সময় প্রায় ৮৬ বছরের পুরোনো এই স্থাপনাটি আগামী ২১ সেপ্টেম্বর থেকে সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে জানান তিনি।
দশ বছর ধরে সারদা হলকে ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল সিসিক। দীর্ঘদিন সিসিকের মালামাল স্তূপ করে রাখায় নষ্ট হয়ে পড়ে এই ভবনের মঞ্চসহ পুরো মিলনায়তন। সংস্কৃতিকর্মীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভবনটিকে পুরোনো রূপে ফেরাতে সংস্কারকাজ করছে সিসিক।
সিসিক সূত্রে জানা যায়, সংস্কারকাজের অংশ হিসেবে সারদা হল মিলনায়তনের মঞ্চ নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ছাদে নতুন ঢালাই দেয়া হয়েছে। এখন চলছে রঙের কাজ। দুই-এক দিনের মধ্যে দর্শক সারির আসন বসানো হবে।
সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি রজত কান্তি গুপ্ত জানান, ২০ সেপ্টেম্বর সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেট ৪০ বছরে পদার্পণ করবে। এ উপলক্ষে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর হবে তিন দিনব্যাপী নাট্য প্রদর্শনী। সারদা হলেই এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে।
তিনি বলেন, তার আগেই হলটির সংস্কার সম্পন্ন করার ব্যাপারে মেয়র আশ্বাস দিয়েছেন।
রজত বলেন, ‘এই সংস্কারকাজের পরও সংস্কৃতি চর্চার জন্য আরও কিছু কাজ করতে হবে। মঞ্চে লাইট, সাইন্ড সিস্টেম ও পুরো হলে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসাতে হবে। আমরা আশা করছি দ্রুততম সময়ে এগুলো সম্পন্ন হবে।’
এই ভবনকে সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা। ওই সমাবেশে হাজির হয়ে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আশ্বাস দিয়েছিলেন, নভেম্বরের মধ্যে মিলনায়তনটি চালু করা হবে, তবে মেয়রের আশ্বাস সত্ত্বেও নভেম্বরে চালু হয়নি মিলনায়তনটি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সারদা হল থেকে নিজেদের মালামাল সরিয়ে এটির সংস্কারকাজ শুরু করে সিটি করপোরেশন।
এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত বলেন, সারদা হল এই অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী মিলনায়তন, যেটি কেবল সংস্কৃতি চর্চার জন্য একটি পরিবারের পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হয়েছিল। অথচ এই ভবনটি দখল করে সিটি করপোরেশন তাদের পরিত্যক্ত মালামালের ভাগাড়ে পরিণত করেছিল। এ ছাড়া সারদা হল কমপ্লেক্স দখল করে বিভিন্ন সময়ে সিটি করপোরেশন ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ভবন নির্মাণ করেছে।
রজত বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে সারদা হল সংস্কার করে এটি সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছি। একই সঙ্গে এই এলাকায় গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে একটি কালচালার কমপ্লেক্স নির্মাণেরও দাবি আমাদের।’
সারদাস্মৃতি ভবনে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
১৯৩৬ সালে সিলেট শহরের সুরমা নদীর তীরের চাঁদনীঘাট এলাকায় নির্মাণ করা হয় ‘সারদাস্মৃতি ভবন’। সংস্কৃতি চর্চার বিকাশে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী পরিবার ৩৯ শতক জমিতে কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের আদলে এই মিলনায়তনটি নির্মাণ করে। এরপর থেকে সিলেটের প্রথম এই মিলনায়তনে গান, নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পরবর্তী সময়ে সিলেট পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে আসছে ভবনটি।
সিসিক সূত্রে জানা যায়, সিলেট নগরীর বন্দরবাজার এলাকার পুরোনো নগর ভবন ভেঙে নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। এ সময় সুরমা নদীর তীরের তোপখানা এলাকায় সিটি করপোরেশন পরিচালিত ‘পীর হাবিবুর রহমান’ পাঠাগারে সিসিকের অফিস অস্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা হয়। আর পাঠাগার বই এনে স্তূপ আকারে রাখা হয় সারদা হলের। এ ছাড়া হলের মূল ভবনের পাশের ছোট ভবনগুলোতে সিসিকের কয়েকটি দপ্তরের কার্যক্রম চালু করা হয়।
সে সময় সিসিকের কর্মকর্তারা জানান, নতুন নগর ভবনের কাজ শেষ হওয়ার পর পুনরায় পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার চালু হবে এবং সারদা হল সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।
এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সিসিকের নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর স্থায়ী ভবনে নিয়ে আসা হয় সিসিকের কার্যক্রম, তবে স্থায়ী ভবনে আসার প্রায় সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত চালু হয়নি পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার। সারদা হলও সংস্কৃতিচর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়নি।
সারদা হলের সংস্কারকাজের দায়িত্বে থাকা সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী সামসুল হক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই অব্যবহৃত থাকায় এই মিলনায়তনের অনেক কিছুই ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে। মঞ্চের সব কাঠ নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো সংস্কার করা হয়েছে। বাকি কাজও শেষের পথে।’
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘মূল স্থাপনা অবিকৃত রেখেই সারদা হলের সংস্কারকাজ করা হচ্ছে। দ্রুত এসব কাজ শেষ হলে এটি পুরোনো রূপে ফিরবে বলে আশা করছি।’