পুলিশের সাময়িক বরখাস্ত অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশীদ, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতা ও রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক মামুনের মধ্যকার ঘটনা নিয়ে পাওয়া গেছে প্রত্যক্ষদর্শী এক সিকিউরিটি সুপারভাইজারের বর্ণনা।
গত ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শাহবাগের ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চতুর্থ তলায় আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে ওই ঘটনা ঘটে। সে সময় হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন সিকিউরিটি সুপারভাইজার ওয়ারেছ আলী।
সংঘাতের শুরু যেভাবে
নিউজবাংলাকে বুধবার বিকেলে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওয়ারেছ আলী বলেন, “যেদিন ঘটনাটি ঘটেছে, সেদিন জড়িত কাউকে আমি চিনতাম না। পরে টিভি/পত্রিকায় খবর পড়ে আমি তাদের পরিচয় জানতে পারি। সেদিন আমি রাউন্ড ডিউটিতে ছিলাম আর আমার কিছু সিকিউরিটি কর্মী নিচে ছিল। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি, হৈ-হুল্লোড় শুনে আমি যখন চতুর্থ তলায় আসি, তখন দেখি, হারুন সাহেব (বরখাস্ত হওয়া রমনা অঞ্চলের এডিসি হারুন অর রশীদ) ইটিটি রুমের সামনে, যেখানে মানুষ ওয়েটিংয়ে থাকে সেখান থেকে লবি হয়ে লিফটের দিকে দৌড় দিচ্ছিলেন। আর তার পেছন পেছন ছুটছিলেন মামুন সাহেব (রাষ্ট্রপতির একান্ত সহকারী সচিব আজিজুল হক), তবে সে সময় লিফট বন্ধ থাকায় এবং নিচ থেকে আরও দুইজন চলে আসায় হারুন সাহেব ফের ইটিটি রুমের দিকে দৌড় দেয়।
“এ সময় মামুন সাহেব এবং নতুন আসা বাকি দুইজনও হারুন সাহেবের পিছু নেয়। এরপর দুই পক্ষই ইটিটি রুমের সামনে গেলে আশেপাশের মানুষও জড়ো হয়ে যায়। আমরা যারা নিরাপত্তাকর্মী আছি, তারাও দৌড়ে যাই। তখন দেখি এই তিনজন হারুন সাহেবকে মারতে চাচ্ছিল। আর উনাকে টেনে নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে চাচ্ছিল। আর হারুন সাহেব চাচ্ছিল ইটিটি রুমের ভিতর ঢুকতে। এরপর আমরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলি, এখানে কোনো গ্যাঞ্জাম হবে না। আপনারা আপনাদের পরিচয় দেন। তখন তিনজনের দলটি আমাদের বলে, ‘তোরা সিকিউরিটি অফিসার। তোদের সাথে কোন কথা নেই। তোরা এখান থেকে সর।’ এর মাঝখানে কেউ একজন হারুন সাহেবের মোবাইল ফোন কেড়ে নিলে আমরা তাদের থেকে মোবাইলটা নিয়ে উনাকে ফেরত দিয়ে দেই।”
ওয়ারেছ বলেন, ‘তখনও তারা সেই পুলিশ অফিসারকে মারতে চাচ্ছিল, কিন্তু আমরা মাঝখানে থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি। যা লেগেছে সব আমাদের গায়ে লেগেছে, তবে শুনেছি, আমরা আসার আগে মারামারি হয়েছে, কিন্তু সেটা আমরা দেখিনি।’
‘ধাক্কাধাক্কিতে খুলে যায় ইটিটি রুমের দরজা’
ওয়ারেছ আলী বলেন, “এ সময় (মারামারি) দুই পক্ষের ধাক্কাধাক্কিতে ইটিটি রুমের দরজা খুলে যায়। সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছিল আমাদের হাসপাতালের রোগী সানজিদা ম্যাডাম (ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি সানজিদা আফরিন)। উনার নামটাও আমরা পরে রিপোর্ট আর টিভিতে দেখে জানতে পেরেছি।
“এরপর পুলিশ অফিসার (হারুন অর রশীদ) ইটিটি রুমের ভেতর ঢুকে রুমের এক কোনায় অবস্থান নেয়। তখন উনাকে দেখে মনে হয়েছে উনি খুব আতঙ্কে আছেন। এদিকে হারুন সাহেব ঢোকার পর পর বাকি সবাইও রুমের ভেতর ঢুকে যায়। তখনও আমরা দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাই। এরপর মামুন সাহেব তার সাথে থাকা লোকজনকে বলছে, ‘ছবি তোল, ভিডিও কর।’ এ সময় আমাদের যিনি রোগী ছিলেন, তিনি এটার প্রতিবাদ করে তাদেরকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। তখন মামুন সাহেবকে তার গায়ে হাত দিতে দেখি।”
ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘এই যখন অবস্থা, তখন আমি সেখান থেকে বের হয়ে আমাদের প্রশাসনকে জানাই। এরপর আমরা ৯৯৯-এ ফোন দিই। আমি যখন বের হচ্ছি তখন এই তিনজন সেই পুলিশ অফিসারকে ধরতে চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা মাঝখানে দাঁড়ানো থাকায় সেটি করতে পারছিলেন না। এ সময় সেখানে একজন ড্রাইভার ছিল। উনিও নিরাপত্তাকর্মীদের সহযোগিতা করে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিল।
‘যেহেতু আমি প্রধান নিরাপত্তাকর্মী, তাই ঘটনার সময় আমার এদিক সেদিক দৌড়ানো লাগছে। তাই সব ঘটনা আমি দেখিনি।’
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রশিদ নামের আরেক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, “ইটিটি রুমের সামনে হাতাহাতি হয়েছিল, তবে কে কার গায়ে হাত তুলেছে সেটা মনে পড়ছে না। ইটিটি রুম খুলে যাওয়ার পরে সবাই যখন ভেতরে ঢুকে যায় তখন এই তিনজন সেই পুলিশ অফিসারকে (হারুন অর রশীদ) বের হতে বলে।
“যেহেতু বের করতে পারলে কিছু হয়ে যেতে পারে, সে জন্য তাদের আমরা বলি, ‘আপনারা আগে বের হন। এরপর আমরা উনাকে বের করছি’, কিন্তু তারা আমাদের কথা না শোনায় আমরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি।”
রশিদ বলেন, “সবাই যখন ইটিটি রুমের ভেতরে, তখন আমাদের যিনি রোগী ছিলেন, উনাকে মামুন সাহেবের উদ্দেশ করে বলতে শুনি, ‘আপনি এখানে কেন? আর উনাকে কেন মারতে চাচ্ছেন? ডাক্তার দেখাতে আমিই স্যারকে নিয়ে আসছি। আপনি চলে যান।’ এরপর মামুন সাহেব বলেন, ‘তুই আসলি কী জন্য? আর ও কেন আসলো?’ এরপর আমাদের রোগী সানজিদা ম্যাডাম বলেন, ‘আমি অসুস্থ, আপনি তো জানেন। আপনি কেন আনেননি আমাকে? তাই আমি স্যারকে নিয়ে আসছি।’”
রশিদ বলেন, ‘এ ছাড়া আরও অনেক কথাবার্তা হচ্ছিল। সব আমাদের ঠিক মনে নেই।’
এই নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ‘এর কিছুক্ষণ পর মূলত পুলিশ আসে। হারুন সাহেব যাকে যাকে দেখিয়েছেন, তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তবে হাসপাতালের ভেতর পুলিশ কাউকে মারধর করেনি।’
ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘ঘটনার শেষে রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে ইটিটি রুমের ভেতরে একটা ভাঙা চশমা পাওয়া যায়। এরপর সেটা আমরা পুলিশে হস্তান্তর করি। তারা সেটা নিয়ে যায়।’
এর আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে চার তলায় থাকা নাম প্রকাশে অনাগ্রহী এক জুনিয়র কর্মচারী নিউজবাংলাকে বলেন, “সেদিন আমি চার তলার সিঁড়িতে বসে ছিলাম। তখন দেখি লিফটের সামনে থেকে হারুনকে (বরখাস্ত হওয়া রমনা অঞ্চলের এডিসি হারুন অর রশীদ) কেউ একজন টেনে কলার ধরে ইটিটি রুমের দিকে নিয়ে গেল। দৌড়ে আমিও সেখানে যাই। এরপর দেখি সেই লোক উনার কয়েকটা ছবি তুলল।
“এ সময় হারুন মাস্ক পরলে সে বলে, ‘মাস্ক পরেন কেন? মাস্ক খুলেন।’ তখন হারুন মাস্ক খুলে বলেন, ‘তোলেন, তোলেন, সমস্যা নেই।’ এরপর এই লোক কাকে যেন ফোনে বলে, ‘তাড়াতাড়ি আসো।’ এরপর আরও তিনজনকে আসতে দেখি। পরে একজন হারুনকে একটা ঘুষি মারে। এ সময় নতুন আসারাও উনাকে কয়েকটা মারছে। এরপর সবাই রুমের ভিতরে ঢুকে যায়।”
এ কর্মচারী বলেন, ‘অনেকক্ষণ পর যখন পুলিশ এসে তাদেরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখন হারুন সাহেবের একটু পাওয়ার আসল। তখন উনি তাদের ওপর হাত তুলতে চেয়েছে, কিন্তু হাত তুলতে পারেনি। দৌড়ে তাদের গায়ে ধাক্কা দিছে।’
সার্বিক বিষয়ে হাসপাতালের প্রশাসন বিভাগের সহকারী পরিচালক কামরুল হাসান বলেন, ‘আমি তখন সেখানে ছিলাম না, তবে নিরাপত্তাকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, আমাদের চার তলায় যেখানে ইটিটি করানো হয়, সেখানে হইচই এবং হট্টগোল শুনে নিরাপত্তাকর্মীরা দৌড়ে যায়। যাওয়ার পরে তারা দেখে তাদের মধ্যে হাতাহাতি কিংবা বাগবিতণ্ডা চলছে। পরে নিরাপত্তাকর্মীরা দুই পক্ষকে আলাদা করার চেষ্টা করেছে।
‘এ সময় আমাদের সিকিউরিটি সুপারভাইজার ওয়ারেছ আলী আমরা যারা প্রশাসনে আছি, তাদের ঘটনা জানিয়ে ৯৯৯ ফোন দেয়। এরপর আমরাও পুলিশকে জানাই। আমাদের ফোন দেয়ার কারণে হোক বা অন্য কারণে হোক হাসপাতালে পুলিশ আসে। এরপর পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়।’