গত কয়েক বছর ধরেই পাটের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় হতাশায় গাইবান্ধার চাষিরা। আর এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা, পাটকল মালিক ও সিন্ডিকেটকে দুষছেন তারা।
কৃষকের উৎপাদিত পাটের সঠিক মূল্য পেতে সিন্ডিকেট ভেঙে তাদের কাছ থেকে সরাসরি পাট কেনাসহ বাজার মনিটরিংয়ের দাবি চাষিদের।
পাটচাষি রহিম বাদশা বলেন, ‘একসময় পাট বিক্রি করে আমাদের সংসারে সচ্ছলতা এসেছিল। হাটে পাট বিক্রি করে আমরা ইলিশ মাছ কিনতাম, কিন্তু ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেটের কারণে পাট বিক্রি করে ইলিশ কেনার দিন আর আসবে না।’
অন্যদিকে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ায় পাট চাষে আগ্রহ হারানোর আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, একদিকে পাটের ব্যবহার বা পাটজাত পণ্যের উৎপাদন না বেড়ে কমছে, অন্যদিকে কৃত্রিম ও প্লাাস্টিক জাতীয় পণ্য ও এর ব্যাগের ব্যবহার সর্বত্রই বেড়েছে। এ কারণে পাটের সুতা থেকে তৈরি পণ্যের আশানুরুপ ব্যবহার বাড়ছে না। ফলে পাটের চাহিদা কমছে।
এ ছাড়া বৈশ্বিক মন্দায় বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের চাহিদাও কিছুটা কমেছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশেও পাটের দাম কম রয়েছে।
অন্যদিকে সরকারি পাটকল বন্ধ হওয়ায় পাটের দামে এই মন্দার বড় কারণ বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
চাষিরা জানান, চলতি বছরে অনাবৃষ্টি বা অতি খরার কারণে গাইবান্ধার এ অঞ্চলে পাটের ফলন কম হয়েছে। অপরদিকে দ্বিগুণ হয়েছে উৎপাদন খরচ। এসবের পরও উৎপাদিত পাট বিক্রির বেলায় কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
পাটচাষিদের অভিযোগ, কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনি আর ধারদেনা করে উৎপাদিত পাটের দাম নির্ধারণ করেন পাটকল মালিক, ফড়িয়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটরা, যে কারণে প্রতি বছরই পাট চাষে পুঁজি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালি, উড়িয়া, ফজলুপুর ইউনিয়ন, সদর উপজেলার কামারজানি ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পাট শুকানোর কাজ করছেন চাষিরা। কেউ কেউ প্রস্তুত করছেন বিক্রির জন্যও। অনেক কৃষক পাট ও পাটকাটি শুকাচ্ছেন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে।
ফুলছড়ি এলাকার এক পাটচাষি বলেন, ‘হাল, সার-বীজ, কীটনাশক থেকে শুরু করে সেচ, নিড়ানি ও পাট কাটা পর্যন্ত যে পরিমাণ খরচ হয়েছে, সেই খরচই উঠবে না এবার। কারণ অতি খরার কারণে পাটের চারা মরে গিয়ে ফলন কম হয়েছে।
‘আর অনাবৃষ্টির কারণে দফায় দফায় সেচ দিতে গিয়ে বাড়তি খরচ করতে হয়েছে। এ ছাড়া পাট কাটার সময়ে পানি না পাওয়ায় খালে সেচের পানিতে পাট জাগ দিতেও বাড়তি খরচ করতে হয়েছে।’
এ উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের পাটচাষি বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান জানান, তার ৪২ শতাংশ জমিতে চাষ থেকে পাট ঘরে তোলা পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২২ হাজার টাকা। পাট হয়েছে মাত্র ৯ মণ। বাজারে প্রতি মণ ভালে মানের পাট দুই হাজার টাকা করে। সে হিসাবে তার ক্ষতি হবে চার হাজার টাকা।
তিনি বলেন, ‘আমি তো সাধারণ কৃষক। এই চার হাজার আমি কোথায় পাব? এ অবস্থা থাকলে আগামীতে পাট চাষে আমার আগ্রহ থাকবে না।’
অন্যদিকে গাইবান্ধার সবচেয়ে বড় পাটের হাট সদর উপজেলার কামারজানী বন্দরে। প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও সোমবারে বসে এ হাট। চলে সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত। সেখানে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও জামালপুরের পাটচাষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পাট কেনাবেচা করে থাকেন।
ওই হাটে গিয়ে দেখা যায়, শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে ভ্যান, ঘোড়ার গাড়ি ও নৌকায় করে বিক্রির জন্য পাট নিয়ে আসছেন চাষিরা। বেচাকেনায় ব্যস্ত কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। হাটে ওই দিন কামারজানী বন্দরে পাটের মানভেদে দাম ছিল এক হাজার ৯০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা।
ওই সময় হাটের উত্তর-পশ্চিম দিকে পাট নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় এক কৃষককে। মোল্লারচরের বয়স ৭০ ছুঁইছুঁই এ বর্গাচাষির নাম আবদুস সোবহান।
তিনি জানান, চার বিঘা জমিতে হাল-সার থেকে শুরু করে বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসতে পাট চাষে খরচ হয়েছে প্রায় ৪২ হাজার টাকা। তিনি অন্যের নৌকায় বিক্রির জন্য দুই মণ পাট বাজারে নিয়ে এসেছেন। ব্যবসায়ীরা প্রতি মণ পাটের দাম বলেছেন দুই হাজার টাকা করে।
এ কৃষক বলেন, ‘আমার চার বিঘা জমিতে পাটের ফলন হয়েছে মাত্র সাত মণ। এ দিনের বাজার অনুযায়ী যার দাম ১৪ হাজার টাকা। খরার কারণে বীজ নষ্ট হয়েছে, গাছ গজায়নি। আমার এ বছর অনেক লোকসান হলো। তা ছাড়া কামলা (শ্রমিক) থেকে প্রত্যেকটি জিনিসের দাম বেশি, কিন্তু পাটের দাম নেই।’
ওই সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা চরের মানুষ। এই মৌসুমে পাট ছাড়া কোনো আবাদ হয় না। বাধ্য হয়ে করতে হয়।’
রাজিবপুর তেলামারি থেকে পাট বিক্রি করতে আসা পাটচাষি রহিম বাদশা বলেন, ‘প্রতি বছরই পাট চাষে কৃষকদের খরচ বাড়ছে, কিন্তু কয়েক বছর থেকে পাটের দাম বাড়ছে না। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম দিচ্ছেন, আমাদের করার কিছুই নেই।’
কামারজানী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল হক বলেন, ‘মূলত পাটকল মালিক ও পাটের বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে তাদের ইচ্ছেমতো পাটের মূল্য নির্ধারণ করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন পাটচাষিরা। পাটকলে বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা বেশি দাম না দিলে তো স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বেশি দামে কেনার সুযোগ নেই।
‘শুধু চাষিরা নয়, অনেক সময় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষককে বাঁচাতে সরকারিভাবে পাটের বাজার মনিটরিং অত্যন্ত জরুরি। তাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও উপকার হবে।’
গাইবান্ধা জেলার পাট অধিদপ্তর কার্যালয়ের মুখ্য পরিদর্শক মকবুল হোসেন সরকার বলেন, ‘আমরা বাজার মনিটরিং করছি। প্রতি মাসেই রিপোর্ট পাঠিয়ে থাকি। গত কয়েক বছর আগে সর্বশেষ সরকারি ২৫টি জুট মিল বন্ধ করেছে সরকার। সরকারিভাবে আর পাট কেনা হচ্ছে না।
‘এখন বেসরকারি ৩০০ পাটকল চালু আছে। তারাও সঠিকভাবে পাট কিনছে না। ফলে বাজারে পাটের দাম কম। এ ছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ীরা গত বছর পাট কিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত লোকসান করেছে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গাইবান্ধার উপপরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ‘গাইবান্ধায় এ বছর পাটের বাজার দর নিয়ে কৃষকদের হতাশা রয়েছে। অতি খরার কারণে সেচ ও পাট জাগ দিতে তাদের বাড়তি খরচ হয়েছে। প্রয়োজনে পাট চাষে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে তাদের কৃষি প্রণোদনা দেয়া হবে।’
ওই সময় উৎপাদন খরচ তুলতে না পারলে অনেক কৃষক যে পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, সে বিষয়টি স্বীকার করে এর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে একযোগে কাজ করতে হবে বলেও জানান তিনি।