বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হাতিরঝিলে প্রকল্পের হাঁসগুলো গেল কই?

  •    
  • ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ২৩:০০

হাতিরঝিলের প্রাকৃতিক গুণাগুণ বৃদ্ধি, সৌন্দর্য বর্ধন ও গবেষণার জন্য চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ৩০০ হাঁস অবমুক্ত করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এসব হাঁসের যত্নে নিয়োগ দেয়া হয় বাড়তি কর্মীও। তবে সেগুলোর মধ্যে এখন আছে ১২৯টির মতো। সে হিসাবে ৭ মাসের ব্যবধানে দুই-তৃতীয়াংশ হাঁস ‘হাওয়া’ হয়ে গেছে।

ইট-পাথরের ঠাঁস বুননে চাপা পড়ে থাকা রাজধানীতে উন্মুক্ত বাতাসে দম নেয়ার জায়গা বলতে গেলে খুবই কম। সেক্ষেত্রে কর্মমুখর জীবনে সামান্য অবসরে দাঁড়িয়ে শ্বাস নেয়ার জায়গা হয়ে উঠেছে হাতিরঝিল। পারিপার্শ্বিক দৃশ্যও বাড়তি এক আকর্ষণ।

ঝিলের সেই আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তুলেছিল ঝিলের পানিতে হাঁসের ছুটোছুটি। ঝিলের পাড় ধরে দাঁড়িয়ে মানুষজন হাঁসের পালের ডুব-সাঁতার দেখতো। কিন্তু মাত্র ৭ মাসের মাথায় সেই চিত্র হারিয়ে যেতে বসেছে। কমে এসেছে পাল ধরে ঝিলের পানিতে ডুব-সাঁতারের দৃশ্যও।

হাতিরঝিলের প্রাকৃতিক গুণাগুণ বৃদ্ধি, সৌন্দর্য বর্ধন ও গবেষণার জন্য চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ৩০০ হাঁস অবমুক্ত করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এসব হাঁসের যত্নে নিয়োগ দেয়া হয় বাড়তি কর্মীও। তবে সেগুলোর মধ্যে এখন আছে ১২৯টির মতো। সে হিসাবে ৭ মাসের ব্যবধানে দুই-তৃতীয়াংশ হাঁস ‘হাওয়া’ হয়ে গেছে।

কিছু হাঁস মারা গেলেও বাকিগুলো কোথায় গেছে সেটা বলতে পারছে না এই হাঁস দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিতদের কেউ। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, অবমুক্ত করা হাঁসগুলোর মধ্যে কিছু মারা গেছে। তবে টিকে থাকা হাঁসের সংখ্যা খুব একটা কমেনি।

হাতিরঝিলে প্রকল্পের হাঁসের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন বেশ কয়েকজন কর্মী। ছবি: নিউজবাংলা

এদিকে প্রকল্পের হাঁসের সংখ্যা যখন কমতির দিকে তখনই নতুন করে পাঁচ হাজার হাঁস হাতিরঝিলে অবমুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে রাজউক। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা তৈরি না করে পরবর্তী প্রকল্প নিলে সেসব হাঁসের পরিণতিও আগেরগুলোর মতোই হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরেজমিনে হাতিরঝিলের আইল্যান্ডে অবস্থিত রাজউকের হাঁসের খামারে গেলে লোহার গেটটি বন্ধ পাওয়া যায়। গেটের কাছে দাঁড়াতেই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা তিন ব্যক্তি আসেন।

তাদের একজন মনিরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মূলত বেসরকারি সিকিউরিটি কম্পানিতে চাকরি করি। গত এক মাস ধরে এই খামারে ডিউটিতে আছি। বর্তমানে এখানে ৫৯টি রাজহাঁস ও ৭০টির মতো পাতিহাঁস আছে। কিছু বেশিও থাকতে পারে। কারণ আমরা সবশেষ যখন গননা করেছি তখন হয়তো কিছু হাঁস পানি বা অন্য জাইগায় ছিল।’

হাঁস পালন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৮টার দিকে হাঁসগুলো ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আর বিকেল ৫-৬টার দিকে ঘরে ঢোকে। আমরা তিন বেলা হাঁসের খাবার দেই। ‘হাঁসের জন্য তিনটি ঘর থাকলেও এখন দুটি ঘরে হাঁস রাখা হয়। বাকি ঘরটিতে হাঁসের খাবার রাখি। আগে তিনটি ঘরেই হাঁস থাকতো শুনেছি। এখন অনেক হাঁস মারা গেছে। আবার অনেক হাঁস চুরি হয়ে গেছে। তাই এখন হাঁস রাখার জন্য তিনটি ঘরের প্রয়োজন পড়ে না।’

হাঁস কিভাবে কারা চুরি করে- এমন প্রশ্নে জবাবে মনিরুল বলেন, ‘কারা চুরি করে এটা আমরা জানি না। তবে আশপাশের মানুষই চুরি করে। মিরপুর থেকে কেউ এসে তো আর এখানে হাঁস চুরি করবে না।

‘আসলে অনেক সময় হাঁসগুলো ঘুরতে ঘুরতে একটু দূরে চলে যায়। আবার কোনো কোনো সময় হয়তো বিশ্রামের জন্য হাঁসগুলো রাস্তার ধারে ঝিলের পাড়ে উঠে যায়। তখন মানুষ এগুলো চুরি করে নিয়ে যায়।

‘এছাড়া আর কিভাবে হাঁস হারাবে? আমাদের সামনে তো কেউ চুরি করতে পারে না। আমাদের নজর যতদূর যায় আমরা সব সময় তত দূর দেখে রাখি।’

হাঁসের নিরাপত্তায় রয়েছে বেষ্টনীর ব্যবস্থাও। ছবি: নিউজবাংলা

হাদিস মিয়া নামে আরেকজন হাঁস দেখভালকারী বলেন, ‘হাতিরঝিল অনেক বড় জায়গা। অনেক সময় হাঁসগুলো একটু দূরে চলে গেলে আশপাশের মানুষ সেগুলো চুরি করে নিয়ে যায়। এভাবে অনেক হাঁস কমে গেছে। তাছাড়া অসুখ-বিসুখেও বেশ কিছু হাঁস মারা গেছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হাঁসগুলো প্রতিদিন গুনে ঘরে তোলা খুব কঠিন। তাই নিয়মিত গণনা করা হয় না। এই যেমন এখন সন্ধ্যা ৬টা বাজে। এখানে (ঘরে) আছে ৬০ থেকে ৭০টি হাঁস। বাকিগুলো এখনও পানিতেই রয়ে গেছে। আস্তে আস্তে ওরা ঘরে আসবে।

‘অনেক সময় হয়তো কিছু হাঁস ঢোকে না, ঝিলের পাড়েই থেকে যায়। তবে মাঝে মাঝে সকালে ঘর থেকে বের করার সময় হাঁসের হিসাব রাখি।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, না। আমরা এই হাঁস খাবো কেন? আমরা তো আরও হাঁস চুরি ঠেকানোর চেষ্টা করি। কিন্তু এই হাতিরঝিল এতো বড় জায়গা যে হাঁসগুলো দূরে চলে গেলে সবসময় খেয়াল রাখা যায় না। তখনই মাঝে মাঝে চুরি হয়।

‘এখানে আমরা ৩-৪ জন এই হাঁসের দেখাশোনার দায়িত্বে আছি। আমরা কম্পানির চাকরি করি আর শাহিন নামের একজন এখানে দায়িত্বে আছেন। তিনি মনে হয় রাজউকে চাকরি করেন। এই হাঁসের বিষয়ে তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আপনি বরং তার সঙ্গে কথা বলুন।’

এরপর মোবাইল ফোনে কথা হয় শাহিনের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রকল্পের এই হাঁসের সংখ্যা নিয়ে আমার কথা বলায় নিষেধ আছে। আপনার যদি কিছু জানার থাকে তাহলে রাজউক প্রধানকে একটা চিঠি দেন। স্যারেরা আমাকে অনুমতি দিলে তখন আমি এই বিষয়ে কথা বলতে পারব।‘

হাঁসের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা দুই কর্মী বলছেন যে এখন খামারে ৫৯টি রাজহাঁস ও ৭০টির মতো পাতিহাঁস আছে। সে হিসাবে সব মিলিয়ে এখন হাঁসের সংখ্যা ১২৯টি। এটা কি সঠিক তথ্য? এমন প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, ‘সত্য-মিথ্য আমি জানি না। আপনাকে বললাম না, এ বিষয়ে আমি কোনো কথাই বলতে পারব না। এই হাঁস প্রতিদিন গোনা সম্ভব না। তাই এখন কতটি হাঁস আছে সেটা আমি জানি না।’

তবে হাঁস চুরি হওয়ার কথা অস্বীকার করেন রাজউকের হাতিরঝিলের প্রকল্প পরিচালক শেখ জিয়াউল হাসান। এরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি বলে দাবি তার।

প্রকল্প পরিচালক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাতিরঝিলে হাঁস ছাড়ার পর শুরুর দিকে বিভিন্ন কারণে ২০-৩০টি মারা গিয়েছিল। তাছাড়া সব হাঁস ঠিকই আছে। এখানে কোনো চুরির ঘটনা ঘটেনি।’

হাঁস রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা বলছেন যে খামারে ১২৯টির মতো হাঁস টিকে আছে। অথচ আপনি বলছেন যে ৩০০ হাঁসের মধ্যে মাত্র ২০-৩০টি মারা গেছে। হাঁসের সংখ্যা নিয়ে দুই রকম তথ্য হয়ে গেল কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়াউল হাসান বলেন, ‘আমার মনে হয় এই তথ্য সঠিক নয়। ওরা এই সংখ্যা কী কারণে বলেছে আমি জানি না। ওরা হয়তো না জেনে বলছে। আমার জানামতে এখানে মাত্র ২০-৩০টি হাঁস মারা গেছে। বাকি সব খামারেই আছে।’

হাঁস চুরি হওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাঁস চুরির প্রশ্নই ওঠে না। ওখানে আমাদের সিকিউরিটির লোক থাকে। নিরাপত্তা বেষ্টনী আছে। তছাড়া এই হাঁস বেশি দূরেও যায় না। দূরে গেলেও আবার চলে আসে।’

শেখ জিয়াউল হাসান আরও বলেন, ‘এটি আমাদের একটি পাইলট প্রকল্প। প্রথমে ৩০০ হাঁস ছেড়ে আমরা গবেষণা করছি হাতিরঝিলের এই পানিতে হাঁসের কোনো সমস্যা হয় কিনা এবং মাছ ও পানির কোনো সমস্যা হয় কিনা।

‘পাইলট প্রকল্প সফল হলে আমরা এই ঝিলে আরও ৫ হাজার হাঁস ছাড়ব। এজন্য আমরা মৎস্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলছি। কারণ এতো হাঁস ছাড়লে মাছের কোন ক্ষতি হবে কিনা। এছাড়া এতো হাঁস ছাড়তে হলে একটা ম্যানেজমেন্ট, একটা জনবল, হাঁসের খাবারের বিষয় আছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে এখন আমাদের পরিকল্পনা চলছে। এগুলো হয়ে গেলে আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই পাঁচ হাজার হাঁস আমরা হাতিরঝিলে ছাড়তে পারব।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি হাতিরঝিলের এই হাঁস পালনকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখি। কারণ এতে হাতিরঝিলের সোন্দর্য যেমন বাড়ে তেমনই হাঁসগুলো পোকামাকড় খেয়ে খেয়ে এর পরিবেশও ভালো রাখে। বিভিন্ন দেশে এরকম লেকে হাঁস পালন করা হয়।

‘কিন্তু কথা হলো হাঁসের যথাযথ নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে কিনা। কারণ আমাদের দেশের কিছু মানুষের মানসিকতাই হলো- যেহেতু সরকারি হাঁস তাই দূরে কোথাও একা একা দেখলেই সেটা ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলা। সেজন্য কর্তৃপক্ষকে রক্ষণাবেক্ষণে বেশি নজর দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘হাঁসের যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেই পরবর্তী পরিকল্পনা এগিয়ে নেয়া দরকার। আরও ৫ হাজার হাঁস ছাড়ার যে পরিকল্পনা রাজউক নিয়েছে তা বাস্তবায়নের আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’

এ বিভাগের আরো খবর