গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রাখালবুরুজ ইউনিয়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ২৫ লাখ টাকার টিআর (টেস্ট রিলিফ) বিশেষ বরাদ্দের অর্থ লুটপাট করে আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে।
২৫টি প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ওই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেত্রী নুরজাহান বেগমের বিরুদ্ধে। এসব প্রকল্পের দ্বিতীয় দফার অর্থ উত্তোলন আছে আটকে।
নুরজাহান বেগম জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সদস্য। তিনি রাখালবুরুজ ইউনিয়নে ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাখালবুরুজ ইউনিয়নে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের টিআর (টেস্ট রিলিফ) বিশেষ বরাদ্দের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৫ লাখ টাকার বিপরীতে ২৫টি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে চারটি মসজিদ, একটি এতিমখানা, একটি কবরস্থান, দুইটি মাদ্রাসাসহ পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ১৪টি গ্রামীণ রাস্তা রয়েছে।
এসব প্রকল্পের প্রত্যেকটির বিপরীতে বরাদ্দের পরিমাণ এক লাখ টাকা, যা বাস্তবায়ন করবে উপজেলা পিআইও কার্যালয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নের নীতিমালা ও অনিয়মের যেসব অভিযোগ
প্রকল্প (রাস্তা) বাস্তবায়ন নীতিমালা অনুযায়ী, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে থাকবে পাঁচ সদস্যের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান অন্য সদস্যের সহায়তায় অর্থ উত্তোলন, হিসাব-নিকাশ, নথিপত্র প্রস্তুত ও সংরক্ষণ করাসহ যাবতীয় কাজ করবেন।
প্রকল্প সভাপতিরা জানান, নুরজাহান বেগম তাদের কাছ থেকে স্বাক্ষরিত চেক নিয়ে টাকা উত্তোলন করেন ও বিভাজন করেন।
নীতিমালায় আরও উল্লেখ আছে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাবে প্রভাবান্বিত না হয়ে প্রকল্পের অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়নের আগে মাটির রাস্তার প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, উপকারভোগী জনসংখ্যা, যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা, সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তার মতো বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প নির্বাচন করতে হবে।
নুরজাহান বেগম ইউনিয়নের ২৫টি প্রকল্পের মধ্যে ২১টি প্রকল্পই দেন ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। ওই ওয়ার্ডে নুরজাহানের বাড়ি, যার মধ্যে রাস্তার প্রকল্প রয়েছে ১২টি।
নীতিমালায় উল্লেখ আছে, পাঁচ সদস্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান বা সভাপতি একই অর্থবছরে তিনটির বেশি প্রকল্পের চেয়ারম্যান হতে পারবেন না।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম উপেক্ষা করে নুরজাহান বেগম ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) জিন্দার আলী তিন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যকে ১৪টি রাস্তার প্রকল্পের বিপরীতে চেয়ারম্যান মনোনীত করেছেন। তিনজনের দুইজন পাঁচটি করে দশটি ও অপরজন চারটি রাস্তার প্রকল্পের সভাপতি।
প্রকল্প বাস্তবায়ন নীতিমালায় গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রামীণ এলাকায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও দরিদ্র জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় শ্রমিকদের কাজ দেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ, রাস্তার প্রকল্পগুলোতে মাটি কাটতে স্থানীয় মাটির সর্দারকে দায়িত্ব দেন নুরজাহান বেগম। চুক্তি অনুযায়ী মাটির সর্দার কাকড়া (ট্রাক্টর) দিয়ে ওইসব প্রকল্পে নামমাত্র মাটি দিয়েছেন।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, পিআইওকে বারবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে সম্পাদিত কাজের গুণগত মান নির্ধারণ, শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক ব্যবস্থা করার নির্দেশনা ছিল। একই সঙ্গে সম্পদ বা অর্থ ছাড়করণের প্রস্তাব বা সুপারিশ করার আগে পিআইওকে অবশ্যই প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করার কথা বলা হলেও পিআইও প্রকল্প এলাকায় যাননি।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ২৫টি প্রকল্পের মধ্যে ‘কাজীপাড়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ সংস্কার’, ‘কাজীপাড়া আমিরুলের বাড়ি হতে দেলোয়ার কাজীর পুরাণ বাড়ির রাস্তা সংস্কার’ ও ‘জাইদুর সরকারের বাড়ি হতে কাজীপাড়া পাকার মাথা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ তিনটি প্রকল্প ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে।
‘আমতলী নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ সংস্কার’ প্রকল্পটি ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। এ ছাড়া বাকি ২১টি প্রকল্পই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে, যার বেশিরভাগই নুরজাহান বেগমের বাড়ির আশপাশে।
এসব প্রকল্পের মধ্যে দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদ সংস্কারে বরাদ্দের পরিমাণ এক লাখ টাকা হলেও মসজিদ কমিটির সদস্যরা কোনো টাকা পাননি বলে অভিযোগ করেন কমিটির সদস্যরা।
তারা জানান, মসজিদে টাকা দেয়ার কথা বলে মসজিদ কমিটির সভাপতির কাছ থেকে নেয়া হয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্বাক্ষরিত দুটি ব্ল্যাংক চেকের পাতা।
একই ঘটনা ‘হরিনাথপুর জামে মসজিদ সংস্কার’ প্রকল্পেও হয়েছে বলে অভিযোগ মসজিদ কমিটির সভাপতির। তার ভাষ্য, তার কাছ থেকেও নেয়া হয়েছে স্বাক্ষরিত চেকের পাতা, কিন্তু কোনো টাকা দেয়া হয়নি মসজিদে।
আরেক প্রকল্প ‘সোনাইডাঙ্গা মধ্যপাড়া জামে মসজিদ সংস্কার’। মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানায়, এই প্রকল্পের সভাপতি নুরজাহানের স্বামী আমিরুল ইসলাম। এ মসজিদে দেয়া হয়নি কোনো টাকা। মসজিদের সামনে মাটি দেয়া হয়েছে তিন ট্রাক (কাকড়া)।
এ ছাড়া ‘নয়াপাড়া জামে মসজিদ সংস্কার’ প্রকল্পের নামে বরাদ্দের কথা জানেন না মসজিদ সংশ্লিষ্ট কেউই।
এদিকে ‘পার সোনাইডাঙ্গা মহিলা হাফিজিয়া মাদ্রাসার মাঠ সংস্কার’ ও ‘ব্রিজ বাজার বালক হাফিজিয়া মাদ্রাসার মাঠ সংস্কার’ ও ‘পার সোনাইডাঙ্গা স্কুলের মাঠ সংস্কার (সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়)’ নামে তিনটি প্রকল্প দেখানো হলেও বাস্তবে দেখা যায় মাদ্রাসা দুটির ও প্রাথমিক বিদ্যালয়টির কোনো মাঠই নেই।
পার সোনাইডাঙ্গা বালক হাফিজিয়া মাদ্রাসার কোনো মাঠ নেই। ছবি: নিউজবাংলা
‘আব্দুল হামিদের বাড়ির পাশে কবরস্থান সংস্কার’ নামে একটি প্রকল্প দেখানো হলেও বাস্তবে এই প্রকল্পের (কবরস্থান) কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
‘সাহেব মিয়ার বাড়ি থেকে আমিরুল ইসলামের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ প্রকল্পটি নুরজাহানের বাড়িতে যাওয়ার ব্যক্তিগত রাস্তা।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, বরাদ্দের ২৫টি প্রকল্পের মধ্যে গ্রামীণ রাস্তা সংস্কারের ১৪টি প্রকল্পের বিপরীতে চেয়ারম্যান মাত্র তিনজন। এর মধ্যে ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আলেস উদ্দিন একাই পাঁচটি প্রকল্পের সভাপতি। এ ছাড়া ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য এনামুল চারটি ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য (১, ২, ৩ নম্বর ওয়ার্ড) রুমা বেগমও পাঁচটি প্রকল্পের সভাপতি।
দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদ প্রকল্পের সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘নুরজাহান বেগম আমাদের মসজিদের নামে ৭০ হাজার টাকার অনুদান তোলার জন্য আমার কাছ থেকে আমার নিজ নামীয় সচল অ্যাকাউন্টের দুটি ব্ল্যাংক চেকের স্বাক্ষরিত পাতা নেন।’
না জেনে স্বাক্ষরিত চেক দিলেন কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি বেইমানি করে, কী করার থাকে।’
নয়াপাড়া জামে মসজিদের ক্যাশিয়ার শাহ আলম বলেন, ‘আমরা কোনো টাকা পাইনি। প্রকল্পের কথাও কেউ আমাদের জানায়নি।’
একই কথা জানান নয়াপাড়া জামে মসজিদের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান।
‘ব্রিজ বাজার বালক হাফিজিয়া মাদ্রাসার মাঠ সংস্কার’ প্রকল্পের সভাপতি আবদুল মোত্তালিব বলেন, ‘সরলতার সুযোগ নিয়েছে নুরজাহান। মাদ্রাসার নামের বরাদ্দ টাকা উত্তোলনের জন্য তিনি আমাদের থেকে ব্ল্যাংক চেকে স্বাক্ষর নিয়েছেন, কিন্তু প্রথম দফার ৫০ হাজার টাকা তুলে আমাদের দিয়েছেন মাত্র ১০ হাজার টাকা। আর কোনো টাকা দেবেন না বলেও জানিয়েছেন।
মাটির সর্দার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এগলা (এগুলো) সরকারি কী প্রকল্প আমি জানি না। নুরজাহান আপা রাস্তার নাম বলে আমাকে মাটি দিতে বলেছে। আমি সেই রাস্তায় দুই গাড়ি, এক গাড়ি করে করে ৭০ গাড়ি (কাকড়া) মাটি দিছি।
‘তার মধ্যে ৫৫ গাড়ি মাটি দিছি তার বাড়ির আগে (বাড়ির উঠানে) এবং তাদের রাস্তায়। ১৫ গাড়ি মাটি দিছি বাকি সবগুলো রাস্তায়। এক গাড়ি মাটির দাম ১২০০ টাকা।’
সংরক্ষিত মহিলা সদস্য (১, ২, ৩ নম্বর) রুমা বেগম বলেন, ‘প্রকল্পের বিষয়গুলো নিয়ে চেয়ারম্যানসহ আমরা বসেছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম আমরা নিজেরাই কাজ করব, কিন্তু উনি (নুরজাহান) বলেছে টাকা খরচ করে প্রকল্প নিয়ে আসছেন। কাজ নিজেই করবেন।’
ওই সময় এক প্রশ্নের জবাবে এই সদস্য বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কথা ছিল প্রত্যেক প্রকল্পের জন্য আমাদের ১৫ হাজার করে টাকা দেবে। এ জন্য আমরা প্রথম দফার চেকে স্বাক্ষর দিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। আমাদের কোনো টাকাই দেয়নি।’
অভিযুক্ত ও সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য
এসব অভিযোগের বিষয়ে নুরজাহান বেগম আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি, তবে গোপন ক্যামেরায় তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের টেবিলে টেবিলে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ করে প্রকল্প নিয়ে আসছি। সবই তো কাজ করার জন্য নয়।’
ওই সময় তিনি পিআইও ও এক উপজেলা নেতার নাম ধরে বলেন, ‘তারা আমাকে বলেছেন প্রকল্প সভাপতিদের দুই হাজার টাকা দিতে ও তিন হাজার টাকার কাজ করতে, কিন্তু আমি তো মসজিদে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা তো মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বরাদ্দ, এটা নেতা-কর্মীদের জন্যই। নেতা-কর্মীরা এই টাকায় কিছু কাজ করলে করবে না করলে কোনো ইয়ে (বাধ্যবাধকতা) নাই।’
পিআইও অফিসের কেউ প্রকল্প পরিদর্শনে আসছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনও কেউ আসেনি। পিআইও অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে অফিসে স্টাম্প ও যাবতীয় লেখালেখির খরচ বাবদ ৮০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। পিআইওকে প্রত্যেক প্রকল্পের জন্য দিতে হয় বরাদ্দের ১৫ শতাংশ টাকা। দুই কিস্তিতে পিআইও অফিসেই সর্বমোট সাড়ে চার লাখ টাকা দিতে হবে।’
এ বিষয়ে দুই দিন একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. জিন্দার আলীকে। পরে উপজেলা কার্যালয়ের তার দপ্তরে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও সাক্ষাৎ মেলেনি, ফলে তার মন্তব্য জানা যায়নি।
এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা-৪) আসনের এমপি প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যাদের এসব সরকারি প্রকল্প দেয়া হয়েছে, তাদের কাজ করতে হবে। কাজ না করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করার সুযোগ নেই।
‘কেউ যদি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করে থাকে বা যাদের আত্মসাতে সংশ্লিষ্টতা থাকবে, তারা ছাড় পাবেন না।’
গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’