সিলেটের এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণে ২০২০ সালের ১ অক্টোবর ২ হাজার ৩০৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয়ে মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর কাজও শুরু করে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, কিন্তু প্রায় ২২ শতাংশ কাজের পর জানা যায়, নকশাতেই গুরুতর ভুল। এ কারণে আটকে যায় সম্প্রসারণকাজ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফের নকশা করে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে হবে। এতে কাজ শেষ হতে বাড়তি আরও দুই বছর সময় লাগবে। এতে বাড়বে ব্যয়ও। অথচ চলতি বছরেই প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, অবকাঠামো নির্মাণের আগে জয়েন্ট ভেঞ্চারে নকশা প্রণয়নের কাজ পায় কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান ‘ইয়োশিন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন’ ও ‘হিরিম আর্কিটেক্ট অ্যান্ড প্ল্যানার্স’। তাদের করা নকশার ওপর ভিত্তি করেই নির্মাণকাজ শুরুর জন্য ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি টেন্ডার আহ্বান করে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এতে চীনের বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (বিইউসিজি) কাজ পায়। ২০২০ সালের ১১ মে প্রকল্পটির চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
মেগা প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ৩৪ হাজার ৯১৯ বর্গমিটারের দ্বিতল আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন, ছয়টি বোর্ডিং ব্রিজ স্থাপন, কনভেয়ার বেল্টসহ ৩৬টি চেক ইন কাউন্টার, ২৪টি পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টার, ছয়টি এস্কেলেটর, ৯টি লিফট, তিনটি লাগেজ কনভেয়ার বেল্ট, ছয় হাজার ৮৯২ বর্গমিটারের কার্গো ভবন, জেট ফুয়েল ডিপো ও কন্ট্রোল টাওয়ারসহ আনুষঙ্গিক আরও কিছু অবকাঠামো নির্মাণ।
২০২০ সালের ১ অক্টোবর ভার্চুয়ালি এ প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলতি বছরের মে মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর বেবিচক প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করে, তবে ২২ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পরই বন্ধ রয়েছে সম্প্রসারণের কাজ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিমানবন্দরের পুরো টার্মিনাল ভবনটিই ভুল নকশায় তৈরি করা হয়েছে। কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানো সেই ভুল নকশায় কাজ হলে ওসমানী বিমানবন্দরের সক্ষমতা কমবে। পণ্য পরিবহনে জটিলতাসহ পোহাতে হবে নানা দুর্ভোগ। এ নকশায় আন্তর্জাতিক রুটে উড়োজাহাজ চলতে গেলে ভেঙে ফেলতে হবে টার্মিনাল ভবন।
এ ছাড়া পুরনো নকশায় থাকা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চলাচল উপযোগী ছোট আকারের উড়োজাহাজের জন্য নির্মিতব্য বোর্ডিং ব্রিজের নকশা পরিবর্তন করে আন্তর্জাতিক রুটের উপযোগী করতে হবে। তাই নতুন করে নকশা পরিকল্পনা করাচ্ছে বেবিচক।
ওসমানী বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা বলছেন, এ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সিলেটের সরাসরি ফ্লাইট বাড়বে। ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে বছরে ২০ লাখ যাত্রী চলাচল করতে পারবে। বর্তমানে ওই বিমানবন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত সাতটি রাজ্যের যাত্রীরাও অন্যান্য দেশ ভ্রমণে এই বিমানবন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হবেন। এ ছাড়া অত্যাধুনিক স্থাপত্যশৈলী ও সুযোগ-সুবিধা সংবলিত দৃষ্টিনন্দন টার্মিনালটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করবে। ফলে ওসমানী বিমানবন্দর এই অঞ্চলের যাত্রীদের জন্য একটি ট্রানজিকশন হয়ে ওঠবে।
এদিকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের কাজ ভুল নকশায় আটকে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবুল মোমেন। সিলেটের বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে সম্প্রতি এক সভায় ড. আবদুল মোমেন ওসমানী বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজে ধীরগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘নকশা আগে যাচাই-বাছাই না করায় এ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি দ্রুত নকশা তৈরি করে প্রকল্পের কাজ শেষ করার তাগিদ দেন।
এর আগে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী ওসমানী বিমানবন্দর পরিদর্শন করে কাজের অগ্রগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওসমানী বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পের নকশা তৈরির কাজ পাওয়া কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান ইয়োশিন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনকে একবার বিশ্বব্যাংক নিষিদ্ধ করেছিল। অস্ট্রেলিয়ার ভানুয়াতুর একটি অ্যাভিয়েশন প্রকল্পে প্রতারণার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটি ১৩ মাস নিষিদ্ধ ছিল।
কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, টার্মিনাল ভবনের ১ হাজার ৪৪৩টি পাইলের মধ্যে অধিকাংশেরই নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। কার্গো টার্মিনাল ভবনের ২৭২টি ও প্রশাসনিক ভবনের ১২৯টি পাইলের মধ্যে সবগুলোর কাজ শেষ হয়েছে।
নতুন নকশায় ওই পাইলগুলো ভাঙার প্রয়োজন পড়বে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক শাহ জুলফিকার হায়দার।
ভুল নকশায় কাজ আটকে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রাভেলস এজেন্ট অফ বাংলাদেশ (আটাব) সিলেটের সাবেক সভাপতি আবদুল জব্বার জলিল বলেন, ‘কাজ শুরু করার আগেই নকশা যাচাই করা দরকার ছিল। তাহলে এ সমস্যা হতো না। এখন মাঝপথে ধরা পড়ায় অনেক লোকসান গুনতে হবে। সিলেটের প্রবাসীদেরও ভোগান্তি বাড়বে।’
তিনি দ্রুত এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার দাবি জানান।
ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শাহ জুলফিকার হায়দার বলেন, ‘বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের নকশায় কিছু সমস্যা ছিল। নকশা তৈরি করা কোরিয়ান কোম্পানিই এই ভুল করেছে। এ কারণে ওসমানী বিমানবন্দর সম্প্রসারণ কাজ আটকে আছে।’
সংশোধিত নকশার ড্রাফট জমা দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি যাচাই-বাছাই চলছে। কিছু সংশোধন আছে, এরপর চূড়ান্ত হবে। নতুন নকশায় কাজের পরিমাণও কিছুটা বাড়বে। আগে ছোট উড়োজাহাজ ও বড় উড়োজাহাজের জন্য বোর্ডিং ব্রিজ আলাদা ছিল। এখন সব বোর্ডিং ব্রিজই বড় উড়োজাহাজের জন্য নির্মিত হবে।
‘এ রকম আরও কিছু সমন্বয় করা হবে। নকশা চূড়ান্ত হতে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে, তবে সিলেটে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় সেপ্টেম্বরে সিভিল ওয়ার্ক করা কষ্টসাধ্য হবে। তাই অক্টোবর থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করতে হবে।’
প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ২২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পাইল ও পাইল ক্যাপের কাজ প্রায় শেষ। এর ওপর স্টিলের পিলার বসানো হবে, তবে নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। মেয়াদ বাড়াতে হবে।
‘ডিজাইন কনসালট্যান্ট ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন মিলে বর্ধিত মেয়াদের সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে, তবে প্রকল্পের মেয়াদ আরও অন্তত দুই বছর বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে। এতে ব্যয় কিছুটা তো বাড়বেই।’