রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যুগ্ম কমিশনার মাসুমা খাতুনকে অপহরণ তার সাবেক স্বামীর পরিকল্পনায় হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
বাহিনীটি জানিয়েছে, অপহরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করেন মাসুমার সাবেক গাড়িচালক মাসুদ।
গত ১৭ আগস্ট রাত আনুমানিক সোয়া ৮টার দিকে এনবিআরের যুগ্ম কর কমিশনারকে রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়। এর ১৮ ঘণ্টা পর রাজধানীর মাদারটেক এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তার সাবেক গাড়িচালক ও সহযোগীদের নামে রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন।
ওই মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তারা হলেন মো. মাসুম ওরফে মাসুদ, আবদুল জলিল ওরফে পনু ও মো. হাফিজ ওরফে শাহনি।
র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-১ ও র্যাব-৩-এর যৌথ অভিযানে শুক্রবার রাতে গাজীপুরের শ্রীপুর ও রাজধানীর সবুজবাগ এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
কারওয়ান বাজারে শনিবার দুপুরে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অপহরণের মামলায় গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য তুলে ধরেন বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তার মাসুদ আগে ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১ আগস্ট ব্যক্তিগত শৃঙ্খলাজনিত কারণে ভুক্তভোগী তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন। ফলে মাসুদের মধ্যে ভুক্তভোগীর প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও আক্রশের সৃষ্টি হয়।
‘গ্রেপ্তারকৃত মাসুদ জানান, তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ায় ভুক্তভোগীর প্রথম (সাবেক) স্বামী হারুন অর রশিদ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ভুক্তভোগীকে উচিত শিক্ষা দিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মাসুদকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখায়।’
তিনি বলেন, ‘মাসুদ জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী হারুন অর রশিদ তাকে অগ্রিম ৭০ হাজার টাকা দেন এবং এই কাজের পরে তাকে আর ড্রাইভিং করতে হবে না ও উন্নত জীবনযাপন করার সকল ব্যবস্থা করে দেবে বলে আশ্বাস দেন। পরবর্তী সময়ে গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় মাসুদ তার সহযোগী হাফিজ, পনু, রাজু, সাব্বির, সাইফুল ও শান্তকে পরিকল্পনার কথা জানায় ও ৭০ হাজার টাকার ভাগ সবাইকে দেয়।
‘ভুক্তভোগীর বর্তমান গাড়িচালকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হাফিজের সুসম্পর্ক থাকায় ভুক্তভোগীর অবস্থান গাড়িচালকের কাছ থেকে জেনে মাসুদকে জানায়।’
যেভাবে অপহরণ
র্যাব জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭ আগস্ট রাত ৮টার দিকে অপহরণকারীরা রাজধানীর বেইলি রোড এলাকায় অবস্থান নেয়। ভুক্তভোগী রাত সোয়া ৮টার দিকে মগবাজার থেকে বেইলি রোড এলাকায় পৌঁছালে অপহরণকারীরা পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি মোটরসাইকেল ও একটি রিকশা দিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ির গতিরোধ করেন। ওই সময় ভুক্তভোগীর চালক মোটরসাইকেল ও রিকশা সরানোর জন্য নামলে তাকে মারধর করা হয়। মাসুদ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এ সময় পনুসহ অন্যান্য সহযোগীরা গাড়িতে উঠে বসে ভুক্তভোগীকে অপহরণ করে হাতিরঝিলের উদ্দেশে রওনা দেন এবং অপহরণের বিষয়টি ভুক্তভোগীর সাবেক স্বামীকে জানান।
র্যাব আরও জানায়, ভুক্তভোগীর সাবেক স্বামী অপহরণকারীদের হাতিরঝিলের একটি বাসার ঠিকানা বলে দিয়ে ভুক্তভোগীকে সেখানে নিয়ে যেতে বলেন, কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা ওই বাসার মেইন গেইট বন্ধ পাওয়ায় ভুক্তভোগীকে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে করে ঘুরে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন।
কমান্ডার মঈন জানান, পরবর্তী সময়ে রাত ১২টার দিকে কাঁচপুর এলাকায় মাসুদের পরিচিত একটি গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপন দাবি করেন অপহরণকারীরা। অপহরণকারীরা দেড় লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন বলে ভুক্তভোগী অভিযোগ করে। পরবর্তী সময়ে অপহরণকারীরা ভুক্তভোগীকে নিয়ে ১৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর মাদারটেক এলাকায় যান এবং জুমার নামাজ পর্যন্ত অবস্থান করেন। ওই সময় মাসুদ ভুক্তভোগীর সাবেক স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তাদের জুমার নামাজের পর হাতিরঝিলের ওই বাসায় নিয়ে যেতে বলেন।
র্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, ওই দিন দুপুরের খাবারের সময় হলে মাসুদ, রাজু ও সাব্বির খাবার আনতে যান। পনু, সাইফুল ও শান্ত গাড়ির বাইরে পাহারায় থাকেন। ওই সময় সুযোগ বুঝে ভুক্তভোগী ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় লোকজন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে আটক করেন। মাসুদ, পনু ও শান্ত কৌশলে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান।
তিনি আরও জানান, পরবর্তী সময়ে পুলিশ এসে ভুক্তভোগীকে হেফাজতে নেয় এবং সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে গ্রেপ্তার করে তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগীর ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।
নারী কর কর্মকর্তাকে অপহরণের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ সাবেক স্বামী হারুন কোথায় জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘তিনি মগবাজারের বাসাতেই অবস্থান করছেন বলে জেনেছি।’
অপহরণে তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েও কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানলে জানতে পারে, তবে র্যাব কর্তৃক গেপ্তারের পর মামলার মূল আসামি মাসুদ আজ সকালে নারী কর কর্মকর্তা অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাবেক স্বামী হারুনের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে।
‘হারুনের নাম মামলার এজাহারে নেই, যে কারণে প্রাপ্ত তথ্য তদন্ত সংস্থাকে জানানো হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।’