‘২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি বাস্তবায়নের প্রতিবাদে আমরা হাজার হাজার মানুষ আন্দোলন করি। আমাদের আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নির্বিচারে গুলি চালায়। ওই সময় ফুলবাড়ীর বাসিন্দা তরিকুল, আমিন, সালেকিন নিহত হন। আহত হন বহু মানুষ। তার মধ্যে আমিও আহত হই।
‘২০০৬ সালের ২৬ আগস্টের পর আমি আর নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারি নাই। ১৭ বছর ধরে বিছানায় শুয়ে আছি। আমার পুরো শরীর পচন ধরেছে। এত বড় ট্র্যাজেডির পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুলবাড়ীবাসীর ৬ দফা চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু ১৭ বছরেও সেই ৬ দফা চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। মৃত্যুর আগে ৬ দফা চুক্তির বাস্তবায়ন দেখে যেতে চাই।’
এভাবে নিজের আক্ষেপের কথা জানাচ্ছিলেন ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি বাস্তবায়নের প্রতিবাদে সৃষ্ট আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আহত ফুলবাড়ী পৌর শহরের সুজাপুর কামারপাড়ার বাসিন্দা বাবুল রায়।
আজ ২৬ আগস্ট। ২০০৬ সালের এ দিনে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি বাস্তবায়নের প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই আন্দোলন তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে তরিকুল, আমিন ও সালেকিন নিহত হন। ওই সময় আহত হন বহু মানুষ। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাবুল রায়। পুলিশের গুলিতে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় তাকে। এরপর থেকে বিছানায় শুয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে বাবুলকে।
তার শরীরে কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত পচন ধরেছে। তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার জন্য সামান্য সহযোগিতা দেয়া হলেও সরকারিভাবে সাহায্য পাননি বলে জানান বাবুল।
এ ব্যক্তি বলেন, ‘২০০৬ সালে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি বাস্তবায়নের প্রতিবাদে আমরা আন্দোলন করি। তৎকালীন বিডিআর আমাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তিনজনকে নিহত ও বহু মানুষকে আহত করেন। পরে ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে ৬ দফা চুক্তি করেছিল, কিন্তু ১৭ বছরেও এ চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। আর কত বছর অতিক্রম করলে ৬ দফা চুক্তি বাস্তবায়ন হবে?’
২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি বাস্তবায়নের প্রস্তাবকারী এশিয়া এনার্জি নামক একটি বহুজাতিক কোম্পানির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাও কর্মসূচি পালন করতে যান আন্দোলনকারীরা। সেই সময় আন্দোলনকারীদের মিছিলে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টিয়ারশেল ও গুলি বর্ষণ করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত ছাত্র তরিকুল ইসলাম, আমিন ও সালেকিন নামে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। একই ঘটনায় আহত হন অনেকে। এখনও সেই গুলির ক্ষত বহন করছে অনেকে।
ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডির ১৭তম বার্ষিকী আজ। কোলাজ: নিউজবাংলা
এরপর ফুলবাড়ীবাসীর টানা চার দিনের গণআন্দোলনের মুখে ৩০ আগস্ট তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে ৬ দফা শর্তে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা ফুলবাড়ী ৬ দফা চুক্তি বলে পরিচিত।
এরপর থেকে দিনটিকে ফুলবাড়ীবাসী ও আন্দোলনকারী সংগঠন তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, ফুলবাড়ী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। একই সঙ্গে ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে সম্পাদিত ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে আন্দোলন করে আসছে।
এদিকে ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এশিয়া এনার্জির প্রধান গেরী এন লাই ফুলবাড়ী পৌর শহরের ফকিরপাড়ায় আসেন। বিষয়টি জানতে পেরে ফুলবাড়ী আন্দোলনকারী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তাদের অফিসে গিয়ে হামলা করে গেরী এনলাইয়ের বহনকৃত কার ভাঙচুর করেন এবং অন্য কিছু গাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করে।
এ ঘটনায় ১০ অক্টোবর এশিয়া এনার্জির মাঠ কর্মকর্তা সাইদুর রহমান বাদী হয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনের ২০ নেতার নামে আলাদা দুটি মামলা করে। মামলা দুটির মধ্যে একটি ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন ও অপরটি ফৌজদারি মামলা, যা বর্তমানে দিনাজপুরে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
৬ দফা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে কয়েক বছর ধরে ফুলবাড়ী স্থানীয়ভাবে গঠিত অরাজনৈতিক সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠন এবং তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি নিয়মিত আন্দোলন করে আসলেও এখন কেবল দিবস পালন ছাড়া সেই আন্দোলন করতে দেখা যায় না। ফলে দিবস পালনের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়েছে ফুলবাড়ীর ছয় দফা চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত তরিকুলের বাবা মোকলেছার রহমান বলেন, ‘সেদিন আন্দোলনের মধ্যে কোনো আন্দোলনকারী হয়তো বা বিডিআরের ওপর ইট-পাথর ছুড়েছিল। কিন্তু এর প্রতিবাদে বিডিআর কেন গুলি চালাল? আমার ছেলের প্রাণ গেল ফুলবাড়ীবাসীর পক্ষে আন্দোলন করতে গিয়ে।
‘ছেলে তো আর ফিরে আসবে না, কিন্তু ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে করা ৬ দফা চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ করব ৬ দফা চুক্তি বাস্তবায়ন করেন।’
তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা কমিটির ফুলবাড়ী শাখার সদস্য সচিব সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীবাসী আন্দোলন করেছি। সরকার ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে ৬ দফা চুক্তি করলেও সেটা আর বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এশিয়া এনার্জির প্রধান গেরী এন লাই আবারও ফুলবাড়ীতে এসে চক্রান্ত শুরু করেন। পরে ওইদিন ফুলবাড়ীবাসী তাকে প্রতিহত করতে বিক্ষোভ মিছিল করে।
‘ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পরে কর্তৃপক্ষ ২০ জনের নামে ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিসাধন ও ফৌজদারি আইনে আলাদা দুটি মামলা করেন। এ ছাড়াও সে সময় ঘটনাটি তদন্তের জন্য কমিটি করা হয়েছিল, কিন্তু সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখনও প্রকাশ হয়নি। অবিলম্বে এ মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার না হলে ফুলবাড়ীবাসীকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’
সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠনের আহ্বায়ক মুরতুজা সরকার মানিক বলেন, ‘আমরা অতীতেও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। এখনও আমাদের আন্দোলন চলমান রয়েছে। আগামীতেও চলমান থাকবে।
‘ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে সম্পাদিত ৬ দফা চুক্তির মধ্যে অন্যতম ছিল যে, আন্দোলনকারীদের নামে কোনো মামলা দেয়া হবে না, কিন্তু ২০১৪ সালে ২০ জন নেতা-কর্মীর নামে এশিয়া এনার্জি দুটি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে করা ৬ দফা চুক্তির তারা ভঙ্গ করেছে। অবিলম্বে মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করতে হবে।’