পড়ন্ত বিকেল। চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুর মোড়ে তখন প্রতিদিনের মতোই রাজ্যের ব্যস্ততা। এর মধ্যেই ভিড় ঠেলে দুই বছর আগে বাবা ছালেহ আহমদ যেখান থেকে স্রোতে ভেসে গিয়েছিলেন, ঠিক সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন সাদেকুল্লাহ মহিম। উন্মুক্ত চশমা খালে সেদিনের মতোই দ্রুতগতিতে বয়ে চলেছে স্রোত। একরাশ বিষণ্ণতা আর হাহাকার নিয়ে আনমনে স্রোতের দিকে অন্তত ১০ মিনিট ধরে তাকিয়ে রইলেন মহিম। ২২ বছরের এই তরুণের চোখের পর্দায় যেন ভাসছিল বাবার চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়ার সেই কষ্টের মুহূর্তের দৃশ্যটা।
খালের পাড় থেকে ওঠার পর বাবার স্মৃতি জানতে চাইতেই, চোখের কোণে আটকে থাকা জল আর বাঁধ মানল না মহিমের। ভেজা চোখ আর অস্পষ্ট স্বর নিয়ে বলে উঠেন, ‘আপনারা চাইলেই তো স্বজনদের কবর জিয়ারত করতে পারেন। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতে পারেন। আমার তো সেই সুযোগটাও নেই ভাই! খুব ইচ্ছে করে বাবার কবরের পাশে দাঁড়াই, তাকে দুটো কথা বলি।’
মহিমের এই দুঃখের কারণ জানতে ফিরে যেতে হবে দুই বছর আগের এই দিনে। ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট ব্যস্ততম মুরাদপুর মোড়ে পা পিছলে সড়ক সংলগ্ন চশমা খালে পড়ে নিখোঁজ হন মহিমের বাবা সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ। সেই থেকে তার এখনো কোনো হদিস মেলেনি। আজ শুক্রবার ছালেহ আহমদের চলে যাওয়ার দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে। তার আগেরদিন গতকাল বৃহস্পতিবার বাবার স্মৃতি খুঁজতে সেই খালের পাড়ে গিয়েছিলেন স্নাতক প্রথম বর্ষে পড়া মহিম। সঙ্গে ছিলেন তার খালু গিয়াস উদ্দিন।
বাবা-মা আর বোনকে নিয়ে মহিমদের ছিল সুখের জীবন। বাবা ছালেহ আহমদের আয় দিয়ে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল তাদের পরিবার। এর মধ্যেই আচমকা বাবার বিদায়ের পর থেকে এখন মহিমদের সামনে শুধুই অন্ধকার। দুই বছরেও পরিবারটি উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এর মধ্যে ছালেহ আহমদের লাশ না পাওয়ার দুঃখ সবাইকে তো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেই।
তবে মহিমদের দুঃখ অনেকটাই কেটে যেত যদি ক্ষতিপূরণের টাকাটা পেতেন। মহিম বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) গাফিলতির কারণেই আমাদের জীবন থেকে বাবা শব্দটি চিরতরের জন্য মুছে গেছে। ঘটনাস্থলে নিরাপত্তা দেয়াল হলে কিংবা জলাবদ্ধতা না হলে দুর্ঘটনার কোনো প্রশ্নই আসত না। কিন্তু তারা কোনো দায় নেয়নি। আমার বাবাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। তিনি না থাকায় এখন আমরা খেয়ে-না খেয়ে বেঁচে আছি।’
অথচ ছালেহ আহমদের নিঁখোজ হওয়ার ঘটনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও দুই সংস্থাকেই দায়ী করা হয়েছিল।
ছালেহ আহমেদের খোঁজ না পাওয়ায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করেছিলেন ছেলে মহিম। সেই রিটের শুনানি শেষে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর আদালত ছালেহ আহমদের পরিবারকে ৬০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল দেন হাইকোর্ট। চসিক মেয়র ও সচিব এবং সিডিএর চেয়ারম্যানকে চার সপ্তাহের মধ্যে ওই রুলের জবাব দিতে বলা হয়। কিন্তু ১১ মাস পার হয়ে গেলেও তার কেউই সেই রুলের জবাব দেননি বলে দাবি করেছে ছালেহ আহমদের পরিবার।
এই বিষয়ে জানতে চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম, সচিব খালেদ মাহমুদ এবং সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সাড়া মেলেনি।
অন্যদিকে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের ফোন ধরলেও তিনি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।