দিনাজপুরে ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট কিছু পুলিশ সদস্যের হাতে কিশোরী ইয়াসমিন আক্তারের ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হওয়ার ২৮তম বার্ষিকী আজ। দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা ওই ঘটনার দুই যুগের বেশি সময় পর উত্তরের জেলাটিতে নারী নির্যাতনের মামলা বাড়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
দিনাজপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের নথি থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ২৩৪ দিনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৯১১টি। সে হিসাবে দৈনিক গড়ে ৩ দশমিক ৮৯টি করে নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে।
৯ শতাধিক মামলার মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগে ১৮৭টি ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মামলা হয় ৫৫টি।
এর আগে ২০২২ সালে এ আদালতে নারী নির্যাতনের মামলা হয় ১ হাজার ৩৭৫টি। সে হিসাবে দৈনিক গড়ে মামলা হয় ৩ দশমিক ৭৭টি।
একই আদালতে ২০২১ সালে মামলা হয় ১ হাজার ২৭৬টি। সে হিসাবে ওই বছর দৈনিক গড় মামলা হয় ৩ দশমিক ৪৯টি।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ ও ২০২৩ সালে দিনাজপুরে ধীরগতিতে বেড়েছে নারী নির্যাতনের মামলা।
কেন বাড়ছে নির্যাতনের মামলা
দিনাজপুরে গত দুই বছরে নির্যাতনের মামলা কেন বেড়েছে, তা জানতে চাওয়া হয় জেলায় এ নিয়ে কাজ করা দুটি সংস্থার কাছে, তবে এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি সংস্থা দুটি।
মহিলা পরিষদ ও পল্লী শ্রীর দুজন কর্মকর্তা জানান, তারা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেন। গত দুই বছরে নির্যাতনের মামলা বাড়ার কারণ তাদের জানা নেই।
এ বিষয়ে দিনাজপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর তৈয়বা বেগম বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর দীর্ঘসূত্রতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে। একটি মামলা ২০০৮ সালে হলে সেটির বিচার শেষ হতে হতে ১০ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত লেগে যায়। এতে অপরাধীদের দ্রুত বিচার করা সম্ভব হচ্ছে না।’
ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার দশমাইলের কাছে কিছু পুলিশ সদস্যের হাতে ধর্ষণের শিকার হয় কিশোরী ইয়াসমিন আক্তার। তার মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ বলতে থাকে, মরদেহটি যৌনকর্মীর। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের সাধারণ মানুষ। শুরু হয় তীব্রতর আন্দোলন।
ইয়াসমিনের মৃত্যুর পর মরদেহ রাখা হয় ভ্যানে। ছবি: সংগৃহীত
আন্দোলনের একপর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বিনা উসকানিতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে সামু, কাদের, সিরাজসহ সাতজনকে হত্যা করে। আহত হন তিন শতাধিক আন্দোলনকারী ও সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শহরে নামানো হয় তৎকালীন বিডিআর।
পরে দিনাজপুর থেকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ ১৩ উপজেলার সব পুলিশকে একযোগে প্রত্যাহার করা হয়।
ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় হওয়া তিন মামলার বিচার হয় তিনটি আদালতে। ১২৩ দিন বিচারকাজ শেষে ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মতিন রায় ঘোষণা করেন।
মামলার রায়ে আসামি পুলিশের এএসআই মঈনুল, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পুলিশের পিকআপ ভ্যান চালক অমৃত লাল বর্ম্মনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। এ রায় রংপুর কারাগারে কার্যকর হয়।
কেমন আছে ইয়াসমিনের পরিবার
ইয়াসমিন হত্যার প্রায় তিন দশক পর পরিবারটি নানা সমস্যায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন কিশোরীর মা।
ইয়াসমিনের বড় ভাই সাহিদার রহমান সোহাগের মেরুদণ্ডের হাড় বেড়ে যাওয়ায় ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারছেন না। কিশোরীর বাবা দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে একটি চাকরি করেন।
ইয়াসমিনের মা শরিফা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ে কয়েকজন কুলাঙ্গারের হাতে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে, কিন্তু এত বছর পার হলেও এখন সেই কুলাঙ্গারদের মতো অনেক কুলাঙ্গার রয়ে গেছে। এখনও প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটছে।
‘দিনটি আসলে কেউ কেউ আমাদের খোঁজ নেয়। পরে আর কেউ খোঁজ নেয় না। আমার ছেলে সাহিদার রহমান সোহাগের মেরুদণ্ডের হাড় বেড়ে যাচ্ছে। সে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারছে না। অর্থের অভাবে ঠিকমতো তার চিকিৎসা করাতে পারছি না আমরা।’
ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল বলেন, ‘আজকের দিনটি দিনাজপুরবাসীর জন্য ঐতিহাসিক দিন। দিনাজপুরে সম্মান, সম্ভ্রম ও মর্যাদাকে রক্ষা করার জন্য দিনাজপুরের মানুষ দল-মত নির্বিশেষে রাজপথে নেমে এসেছিল।
‘দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের কারণে ইয়াসমিনের ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, তবে এই দীর্ঘদিনেও নারী নির্যাতন বন্ধ হয়নি। নারী নির্যাতন বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’