চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের নয়াখাল এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অতিক্রম করেছে নির্মাণাধীন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন। সে রেললাইন ধরে উত্তর-পূর্ব দিকে মিনিট দুয়েক হাটলেই চোখে পড়বে তাঁবু গেড়ে তৈরি কয়েকটি বসতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জরাজীর্ণ তাঁবুতে বাস ৪৫ বছর বয়সী সলেমা খাতুনের।
দুই মেয়ে ও এক ছেলের জননী সলেমার ঘর রেললাইনের কয়েক গজের মধ্যেই। দুই মেয়ের একজনকে বিয়ে দিয়েছেন, অন্যজন স্থানীয় কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়েন। একমাত্র ছেলে স্থানীয় বাজারে মুদি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ নিয়েছেন সম্প্রতি।
সলেমার স্বামী আবুল কাশেম ইটভাটার শ্রমিক। মাসিক ১০ হাজার টাকা মজুরি তার। এ আয় দিয়েই চলে সংসার।
ছেলের প্রচণ্ড পেটে ব্যথা হওয়ায় গত ৮ আগস্ট তাকে নিয়ে স্থানীয় হাসপাতালে যান সলেমা। পরের দিন সেখান থেকে ফিরে দেখেন ঘরে হাঁটু পর্যন্ত পানি। দ্রুত পানি বাড়তে থাকায় কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে রেললাইনে তাঁবু গাড়েন তিনি। একপর্যায়ে পুরো ঘরটাই পানির নিচে চলে যায়।
রেললাইনের যে অংশে তিনি ও তার প্রতিবেশী কয়েকজন তাঁবু গেড়েছেন, সে অংশটা তুলনামূলক উঁচু, কিন্তু বন্যার পানি ওই উঁচু অংশও স্পর্শ করেছে।
এখন পানি কমলেও ঘরের মেঝে পানির নিচে। তাই ঘর সংস্কার শুরুর সুযোগও নেই।
৪৫ বছরের জীবনে চট্টগ্রামে এমন বন্যা আর দেখেননি সলেমা খাতুন। বন্যায় নিজের সহায়-সম্বল হারানোর গল্প বলতে বলতে কণ্ঠ জড়িয়ে আসে তার। চোখ বেঁয়ে ঝরে পড়ে অশ্রু।
সলেমা খাতুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জিনিসপাতি কিছু আনতে পারি নাই। কাপড়-চোপড় নিয়ে সাঁতরে চলে আসছি।
‘পানি কমার পর একটা আলমারি ও খাটের কিছু অংশ বের করেছি সাঁতরে। যতদিন পানি পুরোপুরি না কমে, ততদিন এভাবেই থাকতে হবে।’
তিনি জানান, রাতে তাঁবুর নিচে রেললাইনের ওপর খাটের তক্তা বিছিয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘুমান। কলেজপড়ুয়া মেয়ে জান্নাতুল মাওয়াকে রেখেছেন দুই কিলোমিটার দূরে নানার বাড়িতে, তবে ঘরছাড়া হওয়ার পর থেকে সবার খাওয়া-দাওয়া সলেমার বাবার বাড়িতেই হয়।
এখন পর্যন্ত দুটি সংগঠনের দুই প্যাকেট ত্রাণ পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
সালেমা জানান, বাসা থেকে পুরোপুরি পানি না কমা পর্যন্ত রেললাইনই ঠিকানা, তবে পানি নামলেও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরটি সংস্কারে যে অর্থ প্রয়োজন, তার সিকিভাগও জমা নেই। এমনকি তার স্বামী শ্রমিক আবুল কাশেম এখনও গত মাসের বেতন পাননি। কারণ বন্যায় ইটভাটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাম্প্রতিক বন্যায় সলেমার মতো ঘর হারিয়েছেন সাতকানিয়ার আরও অন্তত আড়াই হাজার পরিবার। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও তিন হাজার ঘরবাড়ি।
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জানান, বন্যায় এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৯ হাজার ১৮৫ পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও ১৮ হাজার ৮৮৫টি ঘর। সব মিলিয়ে সাড়ে আট লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি আরও জানান, সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার পাকা ও ৩৭০ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়। নষ্ট হয়েছে ১১ হাজার ৩২৭ হেক্টর জমির ফসল, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এক লাখ ১৬ হাজার কৃষক।
ট্রলার ও বিভিন্ন ছোটখাটো নৌযানসহ বন্যায় তলিয়ে গেছে প্রায় সাড়ে ৬৯ লাখ টাকার মাছ। প্রাণিসম্পদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৯ কোটি ৩১ লাখ টাকার।