বৃহস্পতিবার প্রবাসী স্বজনের মরদেহ আনতে ঢাকায় যাচ্ছিলেন শরীয়তপুরের বেলায়েত হোসেন ইমরোজ। চলন্ত বাসে পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার সামনে থাকা অবস্থায় জানতে পারেন বিসিএসের ফল প্রাকাশের খবর।
নির্দিষ্ট ওয়েব সাইটে গিয়ে শিক্ষা ক্যাডারের দ্বিতীয় স্থানে নিজের রোল নম্বর খুঁজে পেয়ে নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। একাধিক সূত্র থেকে নিজের সফলতার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রথমেই বাবা-মাকে জানান এ আনন্দের সংবাদটি।
সফলতার এ মুহূর্তটি মোটেও মসৃণ পথে হেঁটে আসেনি ইমরোজের জীবনে। তার বাবা একজন চা বিক্রেতা। বাবার চায়ের দোকানেই চা বিক্রি করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপরা করতে হয়েছে তাকে। আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়ালেখা করলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার খরচ কোথা থেকে আসবে- তা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় ইমরোজের জীবনে। খবর পেয়ে এগিয়ে আসেন বিনোদপুর মৌলভীকান্দি দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষকরা। বিনা খরচে ইমরোজের লেখাপরার দায়িত্ব নেয় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করা বেলায়েত হোসেন ইমরোজ। ছবি: সংগৃহীত
রাত ১০টা পর্যন্ত চা বিক্রির পাশাপাশি চালিয়ে যেতেন নিজের পড়ালেখা। অনেক সময় রাতে দোকানেই ঘুমাতে হতো তাকে। এভাবেই চলতে থাকে তার শিক্ষাজীবন।
অষ্টম শ্রেণি পাশের সময় বোনের বিয়ে হওয়ায় অর্থাভাবে পড়ালেখা বন্ধের যোগাড় হয়েছিল ইমরোজের। কিন্তু মায়ের ইচ্ছায় হাজারো বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও পড়ালেখা চালিয়ে যান তিনি। এর এক পর্যায়ে ২০১২ সালের দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। ভর্তি হন শরীয়তপুর সরকারি কলেজে।
পড়ালোখার খরচ যোগাতে তখন অন্যের বাড়িতে টিউশনি শুরু করেন ইমরোজ। ২০১৪ সালে এইচএসসিতেও শরীয়তপুর সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি)।
২০১৯ সালে ঢাবি থেকে দর্শনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করেন তিনি। এরপর শুরু করেন বিসিএসের প্রস্তুতি। প্রথমবার ৪০তম বিসিএসে সফলতা না আসলেও ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় হন ইমরোজ।
ইমরোজ জানান, ছেটোবেলা থেকেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। লেখাপড়ার আগ্রহ থাকলেও আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। বাবার চায়ের দোকানের পাশাপাশি সময় দিতে হতো কৃষিকাজেও। বিসিএস প্রস্তুতির মধ্যে করোনায় সব বন্ধ ছিল। এ সময় স্ত্রীর সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সমাজের বঞ্চিত মানুষের ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করতে চাই আমি। আমার মতো এমন কষ্ট করে যেন কাউকে পড়ালেখা করতে না হয়, সে বিষয়ে সবসময় কাজ করতে চাই।’
ইমরোজের মা হালিমা বেগম বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমার ছেলে বিসিএস পাশ করছে। আমাগো সকল কষ্ট ভুইলা গেছি।’
বাবা শমছু তালুকদার বলেন, ‘পোলার উছিলায় আল্লাহ চাইলে সুখের মুখ দেখমু। সবার কাছে আমার ছেলের জন্য দোয়া চাই।’
এর আগে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন ইমরোজ। বর্তমানে বড় সন্দীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে শিক্ষকতা করছেন তিনি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সানাউল্লাহ বলেন, ‘ইমরোজ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই বিদ্যালয়ের পরিবেশ বদলাতে শুরু করেছে। শিক্ষার্থীদেরও অনেক মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করান তিনি। শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে পড়াতে ভালোবাসেন তিনি।’