হরিজন সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক পরিবার এখন আর ভাসমান নয়। প্রথম বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহারের ঘর পেয়েছেন সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত এই মানুষগুলো। সে সুবাদে এখন থেকে আর ওদেরকে এক জায়গা থেকে অন্যত্র ঘুরে ঘুরে অস্থায়ী ঠিকানা গড়তে হবে না।
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা জুড়ে অস্থায়ীভাবে ভাসমান হরিজনদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে হরিজন পল্লী। এখানে উপজেলার হরিজন সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক পরিবারের স্থায়ী ঠিকানার ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার থানাহাট ইউনিয়নের সবুজপাড়া এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে নতুন এই হরিজন পল্লী আবাস। নতুন আবাসনের চারপাশে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। সারিবদ্ধভাবে লাল রঙের চালাবিশিষ্ট হলুদ রঙের সেমি পাকা ভবন দাঁড়িয়ে আছে।
সাজানো-গোছানো এই পল্লীর ৩০টি ঘরে আশ্রয় হয়েছে দেড় শতাধিক হরিজন পরিবারের। ইতোমধ্যে তারা পরিবার নিয়ে উঠতে শুরু করেছেন নতুন বাড়িগুলোতে। সমাজের অবহেলিত এসব মানুষ স্থায়ী ঠিকানা পাওয়ায় আনন্দ বিরাজ করছে এ পল্লীতে।
হরিজন পল্লী আবাসের উঠোনে খেলায় মেতেছে হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুরা। ছবি: নিউজবাংলা
নতুন এ আবাসনে বসবাসরত সুমি রানী বলেন, ‘সমাজ আমাদের একটু ভিন্ন চোখে দেখে, অনেকে ঘৃণাও করে। ছোট ছোট সন্তান নিয়ে বিভিন্ন অফিসের বারান্দা কিংবা বাজারে দোকানের বারান্দার নিচে ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে দিন-রাত পার করতে হয়েছে। কেউ কোনোদিন আমাদের জন্যভাবেনি, খোঁজও রাখেনি। কী কষ্টে আমাদের মতো সুইপারদের জীবন কাটে তা বলে বুঝানো যাবে না। সরকার যে আমাদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে স্থায়ী ঘরের ব্যবস্থা করেছে আমরা এতে ভীষণ খুশি। এক বেলা কম খেলেও নিশ্চিতে রাতে পরিবার নিয়ে ঘুমাতে পারব।’
আরেক হরিজন পারুল বলেন, ‘বাপ-দাদাসহ পূর্বপুরুষ সবাই রাস্তার ধারে ও পরিত্যক্ত স্থানে তাদের জীবন কাটিয়েছে। স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমাদের জন্য স্থায়ী ঘর হবে। বিনা পয়সায় জমিসহ পাকা ঘর পেয়েছি এটা ভাবতেই চোখে পানি চলে আসে। এখনও স্বপ্ন দেখার মতোই মনে হচ্ছে।’
সুবিধাভোগী নেমু লাল বলেন, ‘লজ্জা-শরম লাগলেও আগে বাপ-ভাই, বোন, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাঙা ঘরে কোনোরকমে থেকেছি। খাবারের কষ্ট, থাকার কষ্ট নিয়ে যেখানে রাত সেখানে কাত অবস্থায় দিন কেটেছে আমাদের।
‘প্রশাসনের মাধ্যমে এই ঘর পেয়ে আমরা ভীষণ খুশি। এক বেলা কম খেলেও পরিবার নিয়ে নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারার শান্তি জুটেছে আমাদের ভাগ্যে।’
আরেক সুবিধাভোগী মনি লাল বলেন, ‘টিনশেড আধা পাকা ঘরের মধ্যে রয়েছে বারান্দাসহ ২টি কক্ষ, রান্নাঘর, টয়লেট, নিরাপদ পানিসহ বিদ্যুতের ব্যবস্থা, ঘরের সামনে উঠান, শিশুদের জন্য খেলার মাঠ, শ্মশান, মন্দির। আমাদের আর যাযাবরের জীবন কাটাতে হবে না। এখানে নিজেদের মতো করে আমরা বাঁচতে পারব।’
চিলমারী ইউএনও কার্যালয় জানায়, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে চতুর্থ পর্যায়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় হরিজন পল্লী গড়ে তোলা হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিঞা চিলমারী সফরে আসেন। এ সময় স্থানীয় প্রশাসন হরিজন সম্প্রদায়ের আবাসন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয় এই আবাসন নির্মাণের।
প্রাথমিকভাবে হরিজন সম্প্রদায়ের ৩০টি পরিবারকে আবাসন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে প্রতিটি পরিবারের জন্য দু’ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রতিটি ঘরে সাড়ে ১৯ ফুট দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ৫ ফুট বারান্দাসহ দুটি কক্ষ, রান্না ঘর, বাথরুম এবং পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়েছে।
হরিজন পল্লীতে প্রবেশের জন্য ১০ ফুট প্রশস্ত একটি রাস্তা রয়েছে চারপাশে। এছাড়াও শিশুদের খেলার মাঠ, শিশু ও বড়দের জন্য পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা, কমিউনিটি সেন্টার, শ্মশান এবং মন্দির নির্মাণ চলমান।
জেলা প্রশাসক সাইদুল আরীফ এ বিষয়ে বলেন, ‘হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য হরিজন পল্লী দেশে একটি ইউনিক মডেল হিসেবে কাজ করবে। প্রধানমন্ত্রীর অনন্য উদ্যোগের কারণে চিলমারীতে এক একর জমিতে ৩০টি পরিবারকে গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। এই পল্লীতে নাগরিক সুবিধার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে।
‘এছাড়াও এখানে বসবাসরত হরিজন সম্প্রদায়কে উন্নয়নের মূল ধারায় আনতে তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। বাচ্চাদের পড়াশোনা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেয়া হবে। বাংলাদেশে এটিই প্রথম হরিজন পল্লী। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প হিসেবে গড়ে তুলতে আরও ব্যবস্থা নেয়া হবে।’