বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বর্ষা শেষ না হতেই ১০ বার ডুবল বন্দর নগরী

  • তাসনীম হাসান ও আরাফাত বিন হাসান, চট্টগ্রাম   
  • ৬ আগস্ট, ২০২৩ ২৩:৪৯

চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতে জুন মাসে থেমে থেমে কয়েকবার ডুবে যায় নগরী। তবে এতদিন দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই পানি অনেকটা নেমে গিয়েছিল। কিন্তু এবার টানা বর্ষণের কারণে পানি সেভাবে নামার সুযোগ পাচ্ছে না। ভোগান্তিটা তাই এবার বেশি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

‘কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু সকালে অফিসে যেতে বাড়ির নিচতলায় নামতেই দেখি সৈকত নিজেই চলে এসেছে ঘরের দুয়ারে!’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দিয়েছেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শামসুল ইসলাম। তার এই স্ট্যাটাসে আপাত মজা লাগলেও অন্তর্নিহিত বেদনাটা অনেক বেশি। নিউজবাংলার সঙ্গে তার কথোপকথনে সেই দুঃখ, ক্ষোভ আর বেদনাটাই উঠে এসেছে।

শামসুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাসা শুলকবহরে। সকালে অফিসে যেতে বাসা থেকে নামতেই দেখি নিচতলায় কোমরসমান পানি থই থই করছে। ফলে আর বের হতে পারিনি তখন।

‘দুপুরের দিকে লুঙ্গি পরে ব্যাগে প্যান্ট-শার্ট নিয়ে বের হই। অনেক চেষ্টার পরও কোনো গাড়ি পাইনি। অনেকটা পথ হেঁটে একটা রিকশা পাই, তাও কয়েক গুণ বেশি ভাড়ায়।’

শামসুলের এই ভোগান্তির বর্ণনা থেকেই চট্টগ্রাম নগরীর বেশিরভাগ মানুষের কষ্ট আঁচ করা যায় সহজেই। কেননা গত তিনদিন ধরে অনেকটাই পানিবন্দি হয়ে আছেন বন্দর নগরীর মানুষ। বাসাবাড়ি তো বটেই, রোববার বিকেল পর্যন্ত সড়কের কোথাও ছিল হাঁটু পানি, কোথাও আবার পানির উচ্চতা কোমর ছুঁয়েছে।

বেশ কিছুদিন ধরে ভ্যাপসা গরমে নগর জীবন অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ঘন ঘন বিদ্যুতের আসা-যাওয়া সেই যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। চট্টগ্রামের সবখানেই তাই ছিল বৃষ্টির জন্য হাহাকার। শেষমেশ বৃষ্টি এল। কিন্তু সেই বৃষ্টি যেন ‘আশার গুড়ে বালি’ হয়ে দেখা দিল চট্টলাবাসীর জীবনে।

পতেঙ্গার লালদিয়ার চর এলাকার বাসিন্দা বিটন তালুকদারের জবানীতে যেন তারই প্রতিধ্বনি। প্রায় বুক সমান পানি ভেঙে খাবারের পানির সন্ধানে বের হওয়ার দুটো ভিডিও চিত্র ফেসবুকে পোস্ট এই তরুণ লিখেছেন, ‘একতলা পুরো ডুবে গেছে। খাবার কক্ষ, ওয়াশ রুম সব ডোবা। দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নিয়েছি।’

বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর চট্টগ্রাম শহরের নিম্নাঞ্চল এ নিয়ে অন্তত ১০ বার ডুবল। এর আগে ২০২২ সালে ১২ বার ডুবেছিল চট্টগ্রাম। আগের বছর ২০২১ সালে ডুবেছিল ১০ বার।

চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতে জুন মাসে থেমে থেমে কয়েকবার ডুবে যায় নগরী। তবে এতদিন দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই পানি অনেকটা নেমে গিয়েছিল। কিন্তু এবার টানা বর্ষণের কারণে পানি সেভাবে নামার সুযোগ পাচ্ছে না। ভোগান্তিটা তাই এবার বেশি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে।

রোববার বিকেল ৩টা পর্যন্ত পূববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ২৩১ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে নগরীর পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। এই অফিসের সহকারী পূর্বাভাস কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে এটাই ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত।’

ঘরে পানি, চুলাও জ্বলছে না

বন্দর নগরে বৃহস্পতিবার রাতে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। পরদিন শুক্রবার বেলা ১১টা পর্যন্ত একটানা ঝরতে থাকে বৃষ্টি। এ থেকেই শুরু হয় জলাবদ্ধতা। একই চিত্র ছিল গত দুদিনও। তবে প্রথম দুদিন বেশিরভাগ অফিস ছুটিতে থাকায় মানুষজনকে তেমন একটা ঘর থেকে বের হতে হয়নি। ফলে ভোগান্তিতেও কম পড়তে হয়েছে। কিন্তু রোববার সাপ্তাহিক কর্মদিবসের প্রথম দিনে অফিসগামী মানুষজনকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

বৃষ্টির কারণে নগরীর প্রধান সড়কের বহদ্দারহাট থেকে দুই নম্বর গেট পর্যন্ত প্রায় কোমরসমান পানি উঠে যায়। পাশাপাশি এই দূরত্বের মধ্যে থাকা শাখা সড়কগুলোও ডুবে গেছে। ফলে এই সড়ক দিয়ে রিকশা ছাড়া তেমন কোনো গাড়ি চলাচল করতে পারেনি। যেসব গাড়ি বের হয়েছে তার মধ্যে বেশিরভাগই পানি ঢুকে বিকল হয়ে মাঝ রাস্তায় পড়ে থাকে।

নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার, চান্দগাঁও, ইপিজেড, আগ্রাবাদ, হালিশহর, চকবাজার, পাঁচলাইশ, বাকলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার হাজারো পরিবার রোববার পানিবন্দি হয়ে ছিল। এমনকি টানা তৃতীয় দিনের মতো কোমর পানিতে ডুবে ছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনও।

গ্যাস-বিদ্যুৎ বন্ধে বাড়তি ভোগান্তি

এদিকে যেসব এলাকার বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে সেসব এলাকায় বন্ধ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ। এতে পানিবন্দিদের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েক গুণ।

নগরীর পাঁচলাইশ থানার মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘বৃহস্পতিবার থেকে বাসায় কয়েকবার পানি প্রবেশ করেছে। সকালেও কোমর পরিমাণ পানি ছিল। বাসায় পানি ঢোকায় বিদ্যুৎ আর গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

‘বাইরে গিয়ে যে খাবার নিয়ে আসব সেই উপায়ও নেই। কয়েক বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, কাল একটা পরীক্ষা আছে। লেখাপড়া করব তারও উপায় নেই।’

চান্দগাঁওয়ের পশ্চিম ফরিদার পাড়া এলাকার বাসিন্দা হাসান আরাফাত বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাসায় পানি কমে গেছে, একদম নেই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে পানি বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা হয়েছে যে বাসায় থাকা আর সম্ভব হচ্ছিল না। সেই পানি আবার ওয়াশরুমেও মিশেছে। ‘বিদ্যুৎ-গ্যাস নেই, সকালের খাবার খেয়েছি বেলা ৩টায়। দুদিন ধরে একই কষ্টে আছি। শুধু আমি না, হাজারো মানুষ এভাবে কষ্ট করছে। তাছাড়া এই পানি ময়লা, বিষাক্ত ও জীবাণুতে ভরা।’

নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বসতবাড়ির পাশাপাশি পানিতে ডুবে গেছে থানাসহ নানা ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

ইপিজেড এলাকার হাজী শাহ জামাল আলী সওদাগর জামে মসজিদের ইমাম মওলানা আদুল আলীম কাসেমী বলেন, ‘মসজিদেও পানি ঢুকে গেছে। মুসল্লিদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পানির কাএণ নামাযও পড়া যাচ্ছে না।’

দুপুরে দেখা যায়, চান্দগাঁও থানায় হাঁটুসমান পানি থই থই করছে।

স্থবির ব্যবসা

জলাবদ্ধতার পানি থেকে রক্ষা পায়নি নিচু অঞ্চলের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। তিনদিন ধরে জলাবদ্ধ নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা।

রিয়াজুদ্দিন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রহিম বলেন, ‘এখানে শত শত দোকান তিনদিন ধরে পানির নিচে৷ কোটি কোটি টাকার পণ্য পানিতে নষ্ট হচ্ছে। দোকানের প্রবেশ মুখে দুই ফুটের পানি নিরোধক দেয়াল দিলে কিছুক্ষণ পরই পানির উচ্চতা তিন ফুট হয়ে যায়। এভাবেই চলছে গত কয়েক বছর।’

চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘শুরুতে পানি উঠছে শুক্রবার। ছুটির দিন হওয়ায় সেদিন সবাই বাইরে ছিল। চাক্তাই খাতুনগঞ্জে আমাদের পাঁচ হাজারের বেশি দোকান। সেসব দোকানে পানি ঢুকে কোটি কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। মূলত কর্ণফুলী মোহনায় নির্মিত স্লুইসগেটের কারণে এটা হচ্ছে। এটা নির্মাণের সময় আমাদের মতামতও নেয়নি সিডিএ।’

আশ্রয়কেন্দ্রে ৮০০ পরিবার

বৃষ্টি শুরুর পর থেকেই পাহাড় ধসের শঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাইকিং করছে জেলা প্রশাসন। রোববার পর্যন্ত নগরীর বিজয় নগর, শান্তিনগর, বেলতলীঘোনা ও মতিঝর্ণা এলাকার পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারী ৮০০ পরিবারকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক এ তথ্য জানান।

বার বার কেন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে সেটি জানতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিমকে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।

এ বিভাগের আরো খবর