‘ছোটবেলা থেকে বাবার সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অনেক গল্প শুনেছি। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাইকেল চালাতেন। বাবার এমন গল্পগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। যখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি, তখন থেকেই আমার একমাত্র বাহন সাইকেল।’
কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লার সাইক্লিস্ট মাহমুদুল হাসান ইফাজ। তার বাড়ি জেলার আদর্শ সদর উপজেলার বানাশুয়া গ্রামে।
ইফাজের বাবা গোলাম মোস্তফা হজ ট্রাভেল এজেন্সির গাইড হিসেবে নিয়োজিত আছেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে ইফাজ ছোট। হোটেল ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা করা ইফাজের সব স্বপ্ন সাইক্লিং নিয়ে।
সাইক্লিং নিয়ে ইফাজ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে সাইকেল নিয়ে আমার পাগলামি শুরু। একবার পাগলামি এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, আমাকে আমার পরিবার মাদকাসক্ত মনে করে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে দিয়ে আসে, তবুও আমি দমে যাইনি। সাইকেল চালিয়েছি।
‘শুধু আমার দেশেই নয়; পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সীমান্ত জেলাগুলো ঘুরেছি, দেখেছি; দেখেছি তাদের বৈচিত্র্যময় জীবন। আমার স্বপ্ন সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ করা।’
ইফাজের বর্ণনায় ওঠে আসে তার সাইক্লিং জীবনের কথা। তার দাবি, তিনি প্রায় এক লাখ কিলোমিটার সাইকেলে চড়েছেন। জিপিএস ট্রাকিং অ্যাপ স্ট্রাভাতে রেকর্ড আছে ৬২ হাজার কিলোমিটার সাইকেলে ঘুরে বেড়ানোর তথ্য। বাকি তথ্যগুলো গুগল ড্রাইভে সেভ করে রেখেছেন।
সাইকেলের এমন নেশায় ঝুঁকিপূর্ণ কিছু কাজ করেছেন ইফাজ। তেমন একটি ঘটনা ২০১৪ সালের। ভারতের কলকাতা থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি সাইকেল র্যালি হবে। এমন তথ্য শুনেই ইফাজ রওনা হন একটি ফিনিক্স সাইকেল নিয়ে। তার ভিসা, পাসপোর্ট নেই। তবুও তিনি ওই র্যালিতে অংশগ্রহণ করবেন।
বাড়ি থেকে টানা দুই দিন সাইকেলে চড়ে বেনাপোল বন্দরে উপস্থিত হন ইফাজ, তবে পাসপোর্ট, ভিসা না থাকায় বন্দর দিয়ে ওপারে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই সাইকেল কাঁধে নিয়ে নদী সাঁতরে ভারতে যান, তবে নদীর চরে ডাকাতের কবলে পড়েন। সে সময় অনেক কষ্টে রক্ষা পান।
ইফাজ জানান, ভারতে সাইকেল র্যালি যারা আয়োজন করেছেন, তারা তার মুখে বাংলাদেশ থেকে কলকাতা ভ্রমণের গল্প শুনে খুবই অবাক হন।
হাতে সাইকেল নিয়ে ভারতের লাদাখে ইফাজ। ছবি: সংগৃহীত
সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অনেক দিন বাড়িতে না ফেরার ঘটনাও ঘটেছে। বাবা মায়ের বকুনি শোনেন, তবে ইফাজের এ নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সাইক্লিংয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন তিনি।
গেল মাসেই ইফাজের সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। এতে মন খারাপ হয় তার। বেশ কিছু দিন হেঁটে বাড়ি থেকে আসা-যাওয়া করেন।
সাইকেল চুরির ঘটনাটি ফেসবুকে অনেকে জেনে ইফাজকে সান্ত্বনা দেন। পরে সাইক্লিস্টরা চোরকে শনাক্ত করে সাইকেলটি উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
সাইকেল নিয়ে ইফাজের এমন অনেক ঘটনা আছে। সেসব বাদে ইফাজ বড় করে দেখেন তার সাইকেল নিয়ে চড়ে বেড়ানোর কথা।
ইফাজ জানান, এক দিনে তিনি টিম বিডিসির সঙ্গে বিরতিহীন ৫০০ কিলোমিটার সাইকেল ভ্রমণ করেছেন। ঢাকা থেকে তার যাত্রা শুরু হয়। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে শেরপুরে যান শুরুতে। পরে কিশোরগঞ্জ গিয়ে আবার ময়মনসিংহের ভালুকায় ফিরে আসেন।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের সব জেলাতেই ঘুরেছেন। তার সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি দুটি বার্তা (শতবর্ষী বৃক্ষ রক্ষা ও ইয়ুথ অ্যাগেইনস্ট ড্রাগ (মাদকের বিরুদ্ধে তারুণ্য) পৌঁছে দেন। এভাবে সাইক্লিং করতে গিয়ে ২০১২ সালে যোগ দেন বিডি সাইক্লিস্ট গ্রুপের সঙ্গে। পরে তার সাংগঠনিক দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার কারণে স্থানীয় কমিউনিটি সংগঠন কুমিল্লা সাইক্লিস্ট গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে নিযুক্ত হন।
চলতি বছর টানা ৪২ দিন সাইকেলে ভারতের ৫টি রাজ্য ভ্রমণ করেছেন। যার মধ্যে ত্রিপুরা, মিজুরাম, আসাম, মেঘালয় এবং পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে। সেখানে সাইকেল ভ্রমণের সময় সাধারণ মানুষের মন উজাড় করা ভালোবাসা পেয়েছেন।
এক যুগের সাইক্লিংয়ে ইফাজের ঝুড়িতে বেশ কিছু অর্জন যোগ হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় সাইকেল রেসে পুরস্কার পেয়েছেন। ভারতের লাদাখে অনুষ্ঠিত এমটিভি ডোয়াথলন সার্টিফিকেট অর্জন, দীর্ঘতম চলমান বাইসাইকেল সিঙ্গেল লাইনে অংশগ্রহণ করে গিনেস সার্টিফিকেট অর্জন করেন।
টিম বিডিসির সঙ্গে ৪৮ ঘণ্টায় রিলে সর্বোচ্চ সাইক্লিংয়ে ১ হাজার ৬৭০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে গিনেস সার্টিফিকেট অর্জন করেন। এ ছাড়াও বিডি সাইক্লিস্ট হল অফ ফেম সার্টিফিকেট অর্জনসহ আরও বেশ কিছু সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
সাইক্লিং নিয়ে ইফাজ তার স্বপ্নের কথা বলেন। এক যুগ ধরে দুই চাকায় পা রাখা এ ব্যক্তি বিশ্বভ্রমণের জন্য মরিয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা চান তিনি।
ভারতের লাদাখে বাংলাদেশের পতাকা হাতে ইফাজ। ছবি: সংগৃহীত
লেখক মনজুরুল আজিম পলাশ বলেন, ‘‘সাইক্লিং কালচার নিয়ে ইফাজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সক্ষমতাও আমাকে মুগ্ধ করেছে। সাইক্লিং নিয়ে ‘কুমিল্লা সাইক্লিস্ট’ নামে তিনি একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তরুণ প্রজন্মকে এ পরিবেশবান্ধব বাহন চালনায় উৎসাহী করছেন এবং ইতোমধ্যে সাইক্লিং নিয়ে বেশ কয়েকটি বড় ইভেন্ট আয়োজন করেছেন।
“তাতে দেশ-বিদেশের সাইকেলচালকরা এসে যোগ দিয়েছেন। মানুষের স্বপ্ন, পরিকল্পনা এবং সাহস যে সবকিছুকে সম্ভব করতে পারে, ইফাজ আবার তার প্রমাণ দিয়েছেন।’’
ইফাজ সাইকেল নিয়ে ভারতের পাঁচটি রাজ্য পাড়ি দিয়েছেন সফলতার সঙ্গে। মূলত এ ভ্রমণের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাত্রা করে নিজের ভ্রমণ সত্তাটাকে নতুন করে আবিষ্কার। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো পাড়ি দিতে ইফাজের সময় লেগেছে অনেক দিন।
নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন ইফাজ । এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও পরিবেশ রক্ষা নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার, বৃক্ষরোপণ ও রক্তদান উল্লেখযোগ্য।
ইফাজ ও তার সাইকেল বহন করেছে সবুজ-বসবাসযোগ্য সম্ভাবনার পৃথিবীর শান্তিময় বার্তা।