প্রায় এক দশক পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার আসছেন রংপুর শহরে। পুত্রবধূকে বরণে ফুল, ব্যানার, ফেস্টুন, তোরণ ও বর্ণিল আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে উত্তরাঞ্চলের মধ্যমণি এ শহরকে।
নগরীর বৈদ্যুতিক পিলার, ল্যাম্পপোস্ট, দেয়াল, গাছ কোথাও যেন ফাঁকা নেই। ধুয়েমুছে চকচকা করা হয়েছে রাস্তাঘাট, রোড ডিভাইডার।
গত কয়েক দিন ধরে চলছিল বাদ্যযন্ত্র ও গানের তালে নেচে-গেয়ে মাইকিং। জনসভাস্থল ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়, জিলা স্কুল মোড়, ডাকঘর মোড়, সুরভী উদ্যান মোড়, পুলিশ লাইনস মোড়, সিটি বাজারসহ বিভিন্ন পয়েন্টে মাইক বসানো হয়েছে। শহরজুড়ে বাজছে ভাওয়াইয়া, জারি-সারি আর ভাটিয়ালি গানের সুর।
জিলা স্কুলের মাঠে নৌকার আদলে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। এ জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী রংপুরে ২৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ৫টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। একই সঙ্গে নতুন প্রতিশ্রুতির ঘোষণাও দিতে পারেন তিনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে যেন প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। দফায় দফায় বর্ধিত সভা করেছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা লীগসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে করে রংপুরের উদ্দেশে রওনা দেবেন। হেলিকপ্টার বেলা দুইটায় রংপুর ক্যান্টনমেন্ট হেলিপ্যাডে অবতরণ করবে। পরে বেলা ২টা ৫ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট হেলিপ্যাড থেকে সড়কপথে রংপুর সার্কিট হাউসের উদ্দেশে রওনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বেলা ২টা ১৫ মিনিটে সার্কিট হাউসে পৌঁছে সার্কিট হাউসের মিলনায়তনে বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
বেলা তিনটায় প্রধানমন্ত্রী রংপুর জিলা স্কুল মাঠের জনসভার উদ্দেশে রওনা দেবেন। বেলা ৩টা ৫ মিনিটে জিলা স্কুল মাঠের মহাসমাবেশে উপস্থিত হবেন তিনি। পরে বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে মহাসমাবেশে বক্তব্য শেষ করে তিনি ক্যান্টনমেন্ট হেলিপ্যাডের উদ্দেশে সড়কপথে রওনা দেবেন। পরে সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখানে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি। প্রধানমন্ত্রীর আগমনে উত্তরের জনপদ জেগে উঠেছে।’
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ সমাবেশের কারণে বিভাগের আট জেলায় দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা আরও উজ্জীবিত হবেন। প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশ সফল করতে তাঁরা দফায় দফায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সমাবেশে ১০ লাখ লোকের সমাগম ঘটানোর আশা তাঁদের।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রংপুর সফর ঘিরে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে নগরে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যে পথে সমাবেশস্থলে যাবেন, সেই পথের চেকপোস্ট থেকে সভামঞ্চ পর্যন্ত সড়কের দুই ধারে ফুটপাতে রং করা হয়েছে। পথের ধুলাবালি সরানোর কাজও শেষ হয়েছে। সমাবেশস্থল জিলা স্কুলের চার দিকের সীমানাপ্রাচীর সাদা কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সার্কিট হাউস ও আশপাশের এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে।
রংপুর জিলা স্কুল মাঠে ইতোমধ্যে মহাসমাবেশস্থল পরিদর্শন করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াসহ দলের অন্য নেতা-কর্মীরা।
পরির্দশন শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বুধবার রংপুর জিলা হাই স্কুল মাঠে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জনসভাটি জনসমুদ্রে রূপ নেবে। এ জনসভা স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসভা হবে। এটি নির্বাচনী জনসভা।
‘এর মধ্য দিয়ে এই নির্বাচনী ক্যাম্পেইন আমাদের শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুর বিভাগকে ঘিরে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন। এর মধ্য দিয়েই তিনি অঞ্চলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরবেন। তার উন্নয়ন পরিকল্পনার গল্প তুলে ধরবেন। এতে ১০ লাখ লোকের সমাগম হবে।’
জাহাঙ্গীর কবির নানক জনসমাবেশ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর জনসভার সকল আয়োজন ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। এই জনসভায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটবে। পুরো রংপুর এই জনসভা ঘিরে জয় বাংলার জনস্রোতে রূপান্তরিত হবে।
‘বিভাগজুড়ে যেভাবে দলীয় নেতা-কর্মীরা প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগ চালিয়েছেন, তাতে আমরা মনে করি রংপুরের মানুষের জন্য এটি হবে ঐতিহাসিক জনসভা। এই জনসভা থেকেই বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস, অগ্নিসন্ত্রাস, মানুষ খুন এবং দেশবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে উত্তরের এই জনপদ (রংপুর) থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
আওয়ামী লীগের রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে ঘিরে রংপুরসহ পুরো বিভাগে উৎসবের আমেজ চলছে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বঙ্গবন্ধুকন্যা, তাই তার কারিশম্যাটিক নেতৃত্বের কারণে দল-মত নির্বিশেষে লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে। গোটা শহর মানুষে মানুষে টুইটম্বুর হয়ে যাবে। আমরা আশা করছি দল-মত নির্বিশেষে এই জনসভায় সব শ্রেণির-পেশার মানুষ অংশ নেবেন। শুধু জিলা স্কুল মাঠ নয়, গোটা শহর মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে জনসমুদ্রে পরিণত হবে।’
এদিকে জনসভাকে ঘিরে পুরো নগরীকে নিরাপত্তা চাদরে ঢেকেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিভিন্ন রুট দিয়ে আসা যানবাহন পার্কিংয়ে নগরীর ২১টি পয়েন্ট নির্ধারণ করেছে মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। বসানো হয়েছে এক হাজারের বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় এক যুগ পর রংপুরে আসছেন। আমরা দল-মত নির্বিশেষে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে স্বাগতম জানানোর জন্য উদগ্রিব হয়ে আছি। জনসভাকে সফল করতে ইতোমধ্যে আমাদের দলের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আমাদের সব স্তরের নেতা-কর্মীরা জনসভায় যোগ দেবেন। এখানে শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগ সভাপতি নন, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। এখানকার পুত্রবধূ। তাই রংপুরে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে আমরা সাফল্যমণ্ডিত করে তুলব।
‘ইতোমধ্যে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি রংপুর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রায় আড়াই লাখ বোতল পানির ব্যবস্থা করার, যাতে তীব্র গরমে মানুষ পিপাসা মিটিয়ে শান্তি পায়। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে জনসভায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছি, যেটা দেখভাল করবে মহানগর পুলিশ।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কথা রেখেছেন। বিগত সময়ে তিনি নিজ দায়িত্বে এ এলাকার উন্নয়ন করেছেন।’
সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি (সনাক) সদরুল আলম বলেন, ‘এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষিভিত্তিক রপ্তানিনির্ভর কলকারখানা নির্মাণ, রংপুর-ঢাকা দিবাকালীন আন্তনগর ট্রেন চালু, সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করা, অর্থনৈতিক জোন তৈরি।’
মহাসমাবেশে রংপুর বিভাগের ৫৮টি উপজেলা থেকে মানুষ উপস্থিত হবেন বলে জানিয়েছেন রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এ কে এম ছায়াদত হোসেন। তিনি বলেন, মহাসমাবেশ সফল করতে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় বর্ধিত সভাও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দলের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা সবাই সমাবেশ সফল করতে বিভিন্নভাবে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
রংপুরে ২৭ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরে এক হাজার ২৪০ কোটি টাকার ২৭ প্রকল্পের উদ্বোধন এবং নতুন করে আরও ৫টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ২৭ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে শেখ রাসেল মিডিয়া সেন্টার, শেখ রাসেল ইনডোর স্টেডিয়াম, শেখ রাসেল সুইমিং পুল, পীরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জলাশয়ের জলাবদ্ধতা নিরসন শীর্ষক প্রকল্প, বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, পালিচড়া স্টেডিয়াম, নলেয়া নদী পুনঃখনন, আলাইকুমারী নদী পুনঃখনন ইত্যাদি। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার নির্মাণ, রংপুর জেলায় বিটাক কেন্দ্র স্থাপন, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়, রংপুর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অফিস ভবন এবং লেডিস হোস্টেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন তিনি।
রংপুরবাসীর দাবি
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, শ্যামা সুন্দরী খাল খনন, বন্ধ চারটি চিনিকল খুলে দেয়া, রংপুর বিভাগের ছয়টি স্থলবন্দর আধুনিকায়ন, অর্থনৈতিক জোন, কৃষিনির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শুরু, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে ১ হাজার শয্যায় উন্নীত করা, রংপুর মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, সদর হাসপাতালে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল করা, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে ১ হাজার বেডে উন্নীত করা, কারিগরি শিক্ষা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা, রংপুর থেকে সরাসরি ব্রড গেজের রেল লাইন নির্মান ও ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান তৈরি, পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ, ভারী শিল্প কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করা, ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর প্রস্তাবিত সেতু বাস্তবায়ন, জামালপুর-রৌমারী ও চিলমারী-পঞ্চগড় রেল সংযোগ স্থাপন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ রংপুরে এসেছিলেন ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর। এ সময় তিনি রংপুরের পীরগঞ্জ ও তারাগঞ্জে দুটি নির্বাচনী জনসভা করেছিলেন। সাড়ে চার বছরের বেশি সময় পর তিনি রংপুরে আসছেন।
এর আগে ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি রংপুর জিলা স্কুল মাঠে মহাজোটের জনসভায় উন্নয়নের দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।