জুলাই মাসে বেড়েছে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার, গায়েবি মামলা ও পুলিশের বলপ্রেয়োগের ঘটনা। গত এক মাসে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৪১টি রাজনৈতিক মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১২ হাজার ৭০২ জনকে।
সোমবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) তাদের মাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। সংস্থাটির সভাপতি সুলতানা কামালের পক্ষ থেকে এ প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ ঘটনাগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই মাসে রাজনৈতিক, নির্বাচনি সহিংসতা ও সভা-সমাবেশে ৪৬টি বাধার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বিরোধীদের বিরুদ্ধে ৪১টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। এতে ১২ হাজার ৭০২ জনকে আসামি করা হয়েছে। যার মধ্যে দুই হাজার ১৭৪ জন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী।
এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১০ হাজার ৫২৮ জনকে। বাকি ১১৯ জনের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জুলাইয়ে ৪১টি রাজনৈতিক মামলার মধ্যে ৩৭টি বিএনপির বিরুদ্ধে, দুটি জামায়াতে ইসলামী ও দুটি মামলা করা হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে যৌথভাবে। মামলাগুলোর মধ্যে পুলিশ ৩৩টি, আওয়ামী লীগ পাঁচটি, আইনজীবী দুটি ও সরকারি বাঙলা কলেজের অফিস সহকারী একটি মামলা করেছেন। এসব মামলায় এক হাজার ৩৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে এক হাজার ১০৭ জন বিএনপি, ৯১ জন জামায়াত কর্মী, তিনজন বিদেশগামী যুবক ও ১৬৩ জনের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদন অনুসারে, গত এক মাসে ৭৬৯ জন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক সহিংসতা ও সভা সমাবেশে বাধার ঘটনায় মোট ৭৬৫ জন আহত ও ৪ জন নিহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ১০৯ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে কৃষক দলের একজন কর্মী এবং তিনজন যুবলীগের কর্মী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পাঁচটি মামলায় পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। ১৮টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ১৩ জন নিহত ও ছয়জন গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন।
জুলাইয়ে দুজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া এক শিশু ও একজন নারী গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তিনজন বিরোধী দলীয় কর্মীকে তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। অপর একটি ঘটনায় একই পরিবারের শিশুসহ তিন সদস্যকে তুলে নিয়ে যাওয়ার এক মাস পর মামলা দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে এমএসএফ বলছে, জুলাই মাসে বিএনপির ১৩ কর্মীকে ভবঘুরে হিসেবে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫ ধারায় ভবঘুরে, অভ্যাসগত ইত্যাদি অপরাধে জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে পুলিশ। কিন্তু পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করেছে, তাদের প্রত্যেকের নাম, ঠিকানা রয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি। দলটি বলছে, রাজনৈতিক কর্মীদের ভবঘুরে হিসেবে গ্রেপ্তার এক নতুন আলামত।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন বলছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকার দলীয় ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহিংসতা, হানাহানি ও হতাহতের ঘটনায় নাগরিক জীবনে উৎকণ্ঠা বেড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সংঘাত-সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বিকার ভূমিকা লক্ষ্য করা গেছে।
অন্যদিকে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে অতি উৎসাহী অপতৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। এতে সুষ্ঠু রাজনীতি করার অধিকার থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে এবং ক্রমাগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা কমছে।
এমএসএফ জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতন ও অপতৎপরতার যে সব অভিযোগ পত্রিকাগুলোতে আসছে তা অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ও ন্যায়বিচারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনেরই নামান্তর। অপরাধ দমনে আইনসিদ্ধ পথ অবলম্বন না করে এ ধরনের আচরণ নাগরিক জীবনে চরম উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ক্রমাগত আস্থাহীনতা বেড়ে চলেছে, যা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর।