ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য আর শোকের আবহে রাজধানীসহ সারা দেশে মুসলমানদের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন পবিত্র আশুরা পালন হচ্ছে।
বিশেষ দিনটি উপলক্ষে রাজধানীতে কড়া নিরাপত্তায় তাজিয়া মিছিল করেছে শিয়া সম্প্রদায়।
মিছিলটি নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে মোতায়েন করা হয় র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ দল।
পুরান ঢাকার লালবাগের হোসেনি দালান ইমামবাড়া থেকে শনিবার ১০ মহররম সকাল ১০টার দিকে তাজিয়া মিছিল বের হয়। ‘হায় হোসেন’, ‘হায় হোসেন’ ধ্বনিতে হাজারও অনুরাগীর অংশগ্রহণে মিছিলটি শুরু হয়। সব বয়সের নারী-পুরুষ এতে অংশ নেয়।
রাজধানীর হোসেনি দালান ইমামবাড়া, বড় কাটারা ইমামবাড়া ও আশপাশের শিয়া সম্প্রদায়ের বিভিন্ন স্থানে শনিবার সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে কালো-লাল-সবুজের নিশান উড়িয়ে তাজিয়া মিছিল বের করা হয়।
কেউ ‘শোকগীতি’ পড়তে পড়তে, কেউবা বাদ্য বাজিয়ে জমায়েতে অংশ নেন।
নারী-পুরুষ ও শিশুদের হাতে ছিল অসংখ্য কালো, লাল ও সবুজ নিশান। বেশির ভাগ মানুষের পরনে ছিল কালো পোশাক। হোসেনি দালান ইমামবাড়া ব্যবস্থাপনা কমিটির আয়োজিত মিছিলে বহন করা হয় ইমাম হোসেন (রা.)-এর সমাধির প্রতিকৃতি।
মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বকশীবাজার, লালবাগ, ফরাসগঞ্জ, পল্টন, মগবাজার এলাকা থেকেও তাজিয়া মিছিল বের হয়। এর মধ্যে হোসনি দালান থেকে সবচেয়ে বড় মিছিল বের হয়।
তাজিয়া মিছিলে অংশ নেয়া শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানরা জানান, যে সত্য প্রকাশে কারবালার ময়দানে জীবন দিতে হয়েছে ইমাম হোসাইনকে (রা.), সে বাণী প্রচার করে যাচ্ছেন তারা। তার দেখানো পথেই অবিচল থাকবে মুসলিম সম্প্রদায়।
তারা আরও জানান, পূর্ব পুরুষের রীতি মেনে তারাও প্রতি বছর ইমামবাড়ায় আসেন। দোয়া করেন পরিবারের জন্য। পাশাপাশি অনেকেই মানত করেন পরিবারের সদস্যদের রোগ মুক্তি চেয়ে। কেউ কেউ আসেন মনের আশা পূরণে। তারা প্রতীকী কবরে মুরগি, ফল, মোমবাতি দিয়ে দোয়া করেন।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ঈসমাইল আহমেদ বলেন, ‘এ দিনে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার অনুসারীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আজ পবিত্র আশুরার দিন আমরা মহানবীর উম্মত হিসেবে দিনটি উদযাপন করি।’
হোসেনি দালান ইমামবাড়ার তত্ত্বাবধায়ক এম এম ফিরোজ হোসেন বলেন, ‘১০ মহররমের দিন ইমাম হোসাইনের পরিবারসহ কারবালায় তার মৃত্যু হয়। শোকের ঘটনা স্মরণে আমরা তাজিয়া মিছিল বের করি।
‘উনার যে ঘোড়া ছিল, সেটিকে স্মরণ করে এখানে ঘোড়া সাজানো হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী হযরত হোসেন (রা.)-এর পুরো পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছিল। তার উদ্দেশে এ শোক আমাদের পূর্বপুরুষরা করে এসেছেন, আমরাও করছি। আশুরার মিছিলের ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনাকে সম্মান জানিয়ে মিছিল বের করা হয়।’
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন স্থানে কাজ করছেন। নিরাপত্তা জোরদারে কাজ করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন ইউনিট।
নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন সোয়াট সদস্যরাও।
আশুরায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে পুলিশ ও গোয়েন্দা তৎপর রয়েছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা।
সুষ্ঠুভাবে তাজিয়া মিছিল সম্পন্ন করতে দা, ছোরা, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি, লাঠি বহন নিষিদ্ধ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সে সঙ্গে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন জানান, পহেলা মহররম থেকে পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। শনিবার আশুরার মিছিলকে কেন্দ্র করে প্রায় ৮০০ পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন।
পুরান ঢাকার হোসেনি দালানে ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর পবিত্র আশুরার তাজিয়া মিছিল প্রস্তুতের সময় বোমা হামলায় দুজন নিহত ও শতাধিক আহত হন।
হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.), শিশুসন্তান জয়নাল আবেদীন ও তার বংশধরসহ ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদত বরণ করেন। তার মৃত্যুর এ দিনটিতে শোক প্রকাশ করে শিয়া অনুসারীরা তাজিয়া মিছিল বের করেন। ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিলটি প্রায় ৪০০ বছর ধরে হয়ে আসছে।