নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে খেয়া পারাপার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন নদীর দু’পাড়ের যাত্রীরা।
পুলিশ খেয়া পারাপার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নৌকার মাঝিরা। তবে মাঝিদের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ।
শুক্রবার সকাল থেকেই সদরঘাট এলাকার খেয়াঘাটগুলোতে দেখা যায় নীরবতা। মাঝিরা ঘাটে নৌকা বেঁধে অবসর সময় কাটাচ্ছেন। তবে অনেক মাঝি লুকিয়ে ঘাটের পাশাপাশি আশপাশের এলাকা থেকে যাত্রী পারাপার করছেন।
অন্যান্য দিনে সকাল থেকেই খেয়াঘাটগুলোতে মাঝিদের হাঁকডাক থাকলেও দেখা গেছে উল্টো চিত্র। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই খেয়া চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় মাঝিরাও বেকার বসে আছেন। যাত্রীরা নদী পার হতে ঘাটে এসে দেখছেন খেয়া চলাচল বন্ধ। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের।
কেরানীগঞ্জ থেকেও সদরঘাট এলাকায় খেয়া নৌকায় আসতে পারছেন না যাত্রীরা। খেয়া পারাপার বন্ধ থাকায় আধ কিলোমিটার দূরের বাবুবাজার ব্রিজ ব্যবহার করে নদী পার হতে হচ্ছে তাদের। তবে এই ব্রিজ পার হতে গিয়েও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। পুলিশের তল্লাশির কারণে হেঁটেই ব্রিজ পার হতে হচ্ছে তাদের৷ রিকশা কিংবা ভ্যানে আগে যাত্রীরা ব্রিজ পার হলেও পুলিশ শুক্রবার সকালেই তা বন্ধ করে দিয়েছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের।
খেয়া মাঝি আফজাল হোসেন বলেন, ‘বুধবার বিকেলেও পুলিশ খেয়া চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল। মঙ্গলবার সকালে একটু চালাইতে পারছি। কিন্তু বিকেল থেকে আবার পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে। তাই নৌকা ঘাটে বেঁধে বসে আছি৷ নৌকা চালাইতে গেলে পুলিশের লোকজন এসে ঝামেলা করে। ঘাটে যাত্রী নিয়ে ভিড়তেই দেয় না।’
রাসেল সরকার নামের আরেক খেয়া মাঝি বলেন, ‘খেয়া চলাচল বন্ধ রাখার জন্য পুলিশ বলে গেছে। বিএনপির সমাবেশের জন্য নৌকা চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। কাল বিকেল থেকেই বেকার বসে আছি। সারাদিন এভাবেই বসে থাকতে হবে। আর তো কিছু করার নাই।’
কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা আসলাম শেখ বলেন, ‘জরুরি কাজে আমাকে ওই পাড়ে যেতে হচ্ছে। ঘাটে এসে দেখি নৌকা চলছে না। গতকাল থেকেই নাকি বন্ধ। এভাবে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দিলে আমরা সাধারণ যাত্রীরাই বার বার ভোগান্তিতে পড়ি। এখন নদী পার হতে গেলে আমাকে আবার অনেক রাস্তা ঘুরে ব্রিজ দিয়ে হেঁটে যেতে হবে।’
ওপারের যাত্রী ব্যবসায়ী মাসুদুল হক বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে এই পাড় থেকে মালামাল কিনে নিয়ে ওই পাড়ে বিক্রি করি। সকালে অনেক কষ্টে এক মাঝিকে রাজি করিয়ে এই পাড়ে আসছি। এখন ভ্যানে করে মালামাল নিয়ে ব্রিজ দিয়ে যেতে হবে। অল্প টাকার ব্যবসায় বাড়তি টাকা খরচ করতে হবে। নৌকা চালু থাকলে এটা হতো না।’
মোজাফফর মিয়া নামের এক পথচারী বলেন, ‘প্রতিদিন নৌকা দিয়েই কেরানীগঞ্জ থেকে সদরঘাটে আসি। খেয়া বন্ধ থাকায় আজ আসতে হলো বাবুবাজার ব্রিজ দিয়ে। রিকশা আসতে দেয় না পুলিশ। তাই হেঁটেই আসলাম।’
ঘাটে বসে থাকা রাহেলা বেগম বলেন, ‘এইডা আর নতুন কি! মিটিং মিছিল হইলেই ঘাট বন্ধ থাকে। আমরা তো দেখতাছি। পুলিশ আইসা না কইরা দিয়া গেছে।’
সদরঘাট ফেরিঘাটের ইজারাদার মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিম বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। খুব সম্ভবত এমন কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। সাময়িক বন্ধ থাকতে পারে। মিছিল-মিটিং ও সমাবেশ হলে নৌকা চলাচল বন্ধ থাকে।’
সদরঘাট নৌ-থানার ওসি শফিকুর রহমান খান বলেন, ‘খেয়া চলাচল বন্ধের বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। পুলিশের পক্ষ থেকে কাউকে খেয়া পারাপার বন্ধ রাখার কথা বলা হয়নি। মাঝিরা কেন বন্ধ রেখেছে তা আমরা জানি না।’
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ শাহ জাহান বলেন, ‘পুলিশের পক্ষ থেকে নৌকা চলাচল বন্ধের কোনো নির্দেশনা নেই। এটি নৌ থানার অধীনে। জনসমাগম বেড়ে গেলে সাময়িক সময়ের জন্য আমরা খেয়া চলাচল বন্ধ রাখার জন্য বলি।’
রাজধানীর সদরঘাটে শুক্রবার লঞ্চ চলাচল ছিল খুবই কম। ছবি: নিউজবাংলা
সীমিতসংখ্যক লঞ্চ চলাচল
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সীমিতসংখ্যক লঞ্চ চলাচল করতে দেখা যায়। এমনকি প্রতি ঘণ্টায় চাঁদপুর রুটে চলাচল করা লঞ্চও এদিন বিকেল ৩টা পর্যন্ত মাত্র ৩টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে। আর ঘাটে ভিড়েছে মাত্র ২টি লঞ্চ।
এ ব্যাপারে সদরঘাটে বিআইডব্লিউটিসির নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দপ্তরের যুগ্ম পরিচালক কবির হোসেন বলেন, ‘লঞ্চ চলাচল করছে। কম কেন তা লঞ্চ মালিকরা বলতে পারবেন। আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ঘাটে রয়েছে। যাত্রীন যেন কোনো ভোগান্তি না হয় সে ব্যাপারে আমরা সজাগ দৃষ্টি রাখছি।’
লঞ্চ মালিক সমিতির মহাসচিব শহিদুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘সমাবেশ হলে এমনিতেই মানুষ ভয়ে যাতায়াত কম করে। লঞ্চ বন্ধ রাখার প্রশ্নই আসে না। যাত্রী কম, তাই লঞ্চ চলাচল সীমিত।’
বাস বন্ধে হেঁটে গন্তব্যে যাত্রা
এদিকে গণপরিবহন বন্ধে বিপাকে পড়েছেন এপার-ওপারের বাসিন্দারা। গুলিস্তান থেকে কোনো বাস ছেড়ে না আসায় বাবুবাজার ব্রিজ দিয়ে অনেকে হেঁটেই গন্তব্যস্থল কেরানীগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেন।
ভুক্তভোগী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরোজ বলেন, সকালে ক্লাস ছিলো, তাই ক্যাম্পাসে এসেছি। সকালে বাস পেলেও এখন তাঁতীবাজারে এসে কোনো বাসই পাচ্ছি না। তাই হেঁটেই রওনা দিচ্ছি।’
আরেক ব্যবসায়ী সোবেল মিয়া বলেন, ‘সকালে এপারে আসছিলাম মাল সামাল নিতে। এসে দেখি সব বন্ধ। কিছুই কিনতে পারলাম না। এখন ওপারে যাবো, বাস পাচ্ছি না। উপায় নেই। এখন হেঁটেই চলে যাবো।’