দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার বাসিন্দা বাবলু ইসলাম। রক্তশূন্যতার কারণে কয়েকদিন আগে শ্যালক শরিফকে দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু বিপাকে পড়েন স্যালাইন নিয়ে। রক্তের পাশাপাশি চিকিৎসক তাকে স্যালাইন দিতে বলেছেন। হাসপাতালে স্যালাইন না থাকায় বাইরের ফার্মেসি থেকে স্যালাইন কিনতে বলেছেন চিকিৎসক। কিন্তু বাইরের ফার্মেসিতেও স্যালাইন নেই। এমতাবস্থায় চরম বেকায়দায় পড়েন বাবলু। পরে বাধ্য হয়ে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার এক ফার্মেসি থেকে তিন প্যাকেট স্যালাইন এনে শ্যালককে দেন তিনি।
এই সমস্যার সম্মুখীন শুধুমাত্র বাবলু ইসলামই হননি। দিনাজপুরের হাজারো রোগী ও তাদের স্বজনদের সমস্যা বর্তমানে এটি। দিনাজপুর সদর হাসপাতাল ও এম. আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি রয়েছে হাজারো রোগী।
গড়ে দিনাজপুরের হাসপাতালগুলোতে কয়েকশ’ নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এর মধ্যে অধিকাংশ তীব্র গরমের কারণে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়াও পানিশূন্যতা, ডায়রিয়া ও কলেরা রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। আর এই সব রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা স্যালাইন। খাবার ওষুধের বিকল্প পাওয়া গেলেও স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে কোনোকিছু পাওয়া না যাওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন রোগীর স্বজনরা।
বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা রয়েছে বেশি দুশ্চিন্তায়। সরকারি হাসপাতালে কিছু স্যালাইন সরবরাহ করা হলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে একেবারেই স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত দাম দিয়ে গোপনে বা অন্য জেলা থেকে স্যালাইন এনে রোগীকে সরবরাহ করতে বাধ্য হচ্ছেন স্বজনরা।
দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, ৫০০ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ভর্তি থাকছে ৮ শতাধিক রোগী। বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালটির ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৩২ জন ও ডেঙ্গু ওয়ার্ডে বর্তমানে ৩৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। অপরদিকে দিনাজপুর সদর হাসপাতালে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ২১০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন।
বাবলু ইসলাম বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমার অসুস্থ শ্যালককে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। হাসপাতাল থেকে স্যালাইন না দেয়ার কারণে বাইরে কিনতে গেছিলাম। দিনাজপুরের কোনো ফার্মেসিতে স্যালাইন পাইনি। পরে এক মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে রংপুরের বদরগঞ্জের এক ফার্মেসি থেকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে ৩ প্যাকেট স্যালাইন কিনে আমার রোগীকে দিয়েছি।’
যেখানে স্যালাইনের গায়ের দাম ৯৫ টাকা, সেখানে আমার ২৫০ টাকা করে প্রতি প্যাকেট স্যালাইন কিনতে হয়েছে।
ফুলবাড়ী উপজেলার সুদিরহাট ডাঙ্গাপাড়ার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘তিনদিন থেকে আমি ফার্মেসিগুলোতে নরমাল স্যালাইন খুঁজছি। কিন্তু কোনো ফার্মেসিতে স্যালাইন পাচ্ছি না। খুব কষ্টে এক ফার্মেসির মালিককে অনুরোধ করার পর ১ প্যাকেট স্যালাইন পাইছি। দাম একটু বেশি রাখছে।”
পার্বতীপুর উপজেলার আমবাড়ী হলুদপাড়ার মোকাররম হোসেন বলেন, ‘নরমাল স্যালাইনের দরকার, কিন্তু নাকি সাপ্লাই নাই। হাসপাতালের সামনের সব দোকানে খুঁজলাম। কোনো দোকানে স্যালাইন পাইলাম না। রোগীকে বাঁচাতে স্যালাইনের দরকার, তাই চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
মুমতাহা ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী মোক্তার আলী বলেন, ‘গড়ে প্রতিদিন ১০০টির বেশি স্যালাইন আমার প্রয়োজন। কিন্তু কোনো ওষুধ কোম্পানি আমাকে এক প্যাকেট স্যালাইনও সরবরাহ করছে না। এটার কারণ একমাত্র ওষুধ কোম্পানি ও সরকার জানে। আমার মনে হয়, এটা ওষুধ কোম্পানিগুলোর একটা বড় ধরণের সিন্ডিকেট।’
দিনাজপুর ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী হাফিজ বলেন, ‘দুই মাস ধরে আমাদের কাছে স্যালাইনের সরবরাহ নেই। রোগীরা আমাদের কাছে এসে প্রশ্ন করছে। কিন্তু বাজারে যদি স্যালাইন নাই থাকে, তাহলে চিকিৎসকরা কেন স্যালাইন লিখছে। আমরা চরম বেকায়দায় রয়েছি।’
মেডিক্যাল ফার্মার স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ফার্মেসিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে অবস্থিত। গত দুই মাস ধরে এনএস স্যালাইন সংকট রয়েছে। আমার দোকানে প্রতিদিন ১০০টির বেশি স্যালাইন বিক্রি হয়। কিন্তু আমাদের কাছে স্যালাইন নাই। ফলে ক্রেতারা স্যালাইন না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তারা আমাদেরকে স্যালাইন দিতে পারছে না।’
দিনাজপুরের ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইনের সরবরাহ নাই- এমন প্রশ্নে দিনাজপুরের ড্রাগ সুপার নার্গিস আক্তার বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। এছাড়া বেশি দামে স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে- এমন কোনো অভিযোগ আমার কাছে এখন পর্যন্ত আসেনি।’
তবে অভিযোগ আসলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘যদি স্যালাইনের সংকট হয়, তাহলে ওষুধ কোম্পানির ডিপোগুলো পরিদর্শন করব। পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
এ ব্যাপারের দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. বোরহান-উল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, ‘এনএস বা সাধারণ স্যালাইন বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও হাসপাতালে ভর্তি হলে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে অনেককে ক্যানোলার মাধ্যমে সাধারণ স্যালাইন দিতে হয়। আর যে সকল রোগী খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না সে সকল রোগীকেও এই সাধারণ স্যালাইন দিতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সাধারণ স্যালাইনের সরবরাহ রয়েছে। আমরা যে কোনো ধরণের পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। কিন্তু বাইরের ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইনের সংকট রয়েছে। এটা ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন পলিসি হিসেবে স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট হতে পারে।’
এ ব্যাপারে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘গরমে ও বর্ষাকালে প্রচুর পরিমাণে ডায়রিয়া রোগী বাড়ে। বর্তমানে আমরা ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বর্তমানে তা আমাদের কন্ট্রোলে আছে। আমার পরামর্শ হলো- কেউ অসুস্থ হলে তাকে যেন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’