হাওলা তথা হুন্ডির মাধ্যমে নিষিদ্ধঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের কাছে অর্থ আসছে জানিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট বলেছে, নন-ব্যাংকিং এ পদ্ধতিতে সম্প্রতি চার দফায় কয়েক কোটি টাকা এসেছে।
সিটিটিসির ভাষ্য, গত সপ্তাহে সর্বশেষ মধ্যপ্রাচের একটি দেশ থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসা ১ কোটি ২০ লাখ টাকা গ্রহণকারী একাধিক জঙ্গি নেতাকে খুঁজছে ইউনিটটি।
সিটিটিসির বম্ব টিমের ইনচার্জ ও অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকটি সন্দেহভাজন হুন্ডির চালান নিয়ে কাজ করছি। এসব চালানে আসা অর্থ দিয়ে জঙ্গিরা কর্মকাণ্ডের দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।’
সন্ত্রাস ও আন্তদেশীয় অপরাধ নিয়ে কাজ করা ইউনিটটির ভাষ্য, গত তিন মাসে আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবির নব্য ও পুরোনো অংশের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা এসেছে। এ মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে আসা অর্থের প্রেরক কিংবা গ্রহণকারী কোনো পক্ষেরই তথ্য না থাকায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান জঙ্গি অর্থায়নে যুক্ত ব্যক্তিরা।
সিটিটিসির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা জানান, এই টাকা প্রথমে মালয়েশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সোনায় রূপান্তর করে ভারতে পাঠানো হয়। তারপর সেখান থেকে হুন্ডির মাধ্যমে সেই টাকা আসে জঙ্গি সংগঠনের ব্যক্তিদের কাছে।
এ ছাড়া পুরোনো জেএমবির কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য একই কৌশলে টাকা আসছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পরিকল্পিত নাশকতার জন্য জঙ্গিদের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। বাসাবাড়ি ভাড়া নেয়া থেকে শুরু করে নাশকতার কাজে ব্যবহৃত বিস্ফোরক কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের জন্য তাদের এই অর্থের দরকার হয়, তবে গুলশানে হোলি আর্টিজানে হামলা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর এখন পর্যন্ত তাদের সেই ধরনের নাশকতা বা হামলার সক্ষমতার কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই তাদের কাছে।’
কী বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেসবাউল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হুন্ডি ও ভার্চুয়াল কারেন্সির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অনেক আগেই সার্কুলেশন জারি করা হয়। সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নন-ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়মিত মনিটর করা সম্ভব না হলেও স্পেসিফিক কোনো ঘটনা ধরা পড়লে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
‘বিশেষ করে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীদের লেনদেনের ক্ষেত্রে নজরদারি করা হয়ে থাকে। কিছুদিন আগেও অননুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীদের তালিকা দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। আমরা যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি না, তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কাছে তাদের বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করেছি।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরও বলেন, ‘ভার্চুয়াল কারেন্সির বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিশেষ সার্কুলার দেয়া হয়েছে। এই মুদ্রার কোনো বৈধতা নেই। বিষয়টি নিয়ে সিআইডি কাজ করে থাকে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সরবরাহ করা তালিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম শাখার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাস তিনেক আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক একাধিক সংস্থার যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ডার্কওয়েবে ভার্চুয়াল কারেন্সি কেনাবেচা চক্রের ওপর নজরদারি করার জন্য বিশেষ জনবল নিয়োগ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই তাদের প্রযুক্তিগত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়েছে।’
সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, আগে থেকেই জঙ্গি অর্থায়নের মাধ্যম হিসেবে হুন্ডি ব্যবহার করত জঙ্গিরা, তবে নয়া মাধ্যম হিসেবে তারা ভার্চুয়াল কারেন্সিতে ঝুঁকছে বেশি। ক্রিপ্টো কারেন্সির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার আদান-প্রদান করছে আইএস ও আল-কায়েদাপন্থিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন। অস্ত্র কেনা, বিস্ফোরক তৈরিসহ সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, জঙ্গি ভাবধারা প্রচারের জন্যও ক্রিপ্টোর মাধ্যমে আসা টাকা চলে যাচ্ছে বিভিন্ন মডিউলে। এই অর্থ আসছে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ থেকে। এমন তথ্য পাওয়ার পর থেকে জঙ্গিদের আর্থিক লেনদেন বন্ধ করার জন্য নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ভার্চুয়াল কারেন্সি লেনদেনের তথ্য শনাক্তে অনেক ক্ষেত্রেই সক্ষম নয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া দেশে অসংখ্য অননুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা প্রতিনিয়ত অর্থের লেনদেন করে থাকে কোনো রকমের তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই। এতে সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য।
জঙ্গি কার্যক্রম অনুসরণকারী এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে কারাগারে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি আছে আড়াই শতাধিক। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ জঙ্গি নেতারাও রয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড পাওয়া আরও অনেক জঙ্গি রয়েছে। এদের মধ্যে আন্তসম্পর্ক বৃদ্ধির চেষ্টা সবসময় হয়ে থাকে। জামিন নিয়ে লাপাত্তা দেড় সহস্রাধিক জঙ্গিও সাংগঠনিকভাবে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এই কাজে মূল দায়িত্ব পালন করছেন জেএমবি ও এবিটির শীর্ষ দুই নেতা উসমান ও সালেহীন। এই দুজন কোথায় আছেন তাও নিশ্চিত নয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা একই প্ল্যাটফর্মে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
কারা, কীভাবে টাকা পাঠাচ্ছেন
পুলিশের একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার ভাষ্য, বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন, বিশেষ করে এবিটি ও জেএমবির পুরোনো ও নব্য সদস্যরাই টাকা সংগ্রহ করছেন। তাদের অধিকাংশই জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছেন। কেউ কেউ দেশের অভ্যন্তরে, আবার কেউ কেউ দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন। মূলত এরাই বেশির ভাগ টাকা সংগ্রহ করে নন-ব্যাংকিংয়ের অবৈধ চ্যানেল ব্যবহার করে কখনও হাওলা বা হুন্ডি, কখনও ভার্চুয়াল কারেন্সি ব্যবহার করছেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ভার্চুয়াল কারেন্সির বেচাকেনা চলছে ডার্কওয়েবে। জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের হয়ে কাজ করছে অনেক ক্রিপ্টো এজেন্ট। অ্যাকাউন্টগুলো রয়েছে তাদের নামে। টাকা জোগাড়ের পর পাঠিয়ে দেয়া হয় এই এজেন্টদের কাছে। এগুলো দিয়ে ক্রিপ্টো কারেন্সি কেনার পর অনলাইনে বিদেশে বা দেশের কোনো এজেন্টের কাছে তা পাঠানো হয়। এরপর সেগুলো ভাঙিয়ে টাকা, রুপি বা ডলার করা হয়। এই অর্থ তাদের হাত ঘুরে পৌঁছে যাচ্ছে জঙ্গিদের তহবিল দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে। এজেন্টদের খোলা অ্যাকাউন্টগুলো নাম-পরিচয়হীন। কেবল নিউমেরিক্যাল নম্বর থাকছে, যে কারণে অ্যাকাউন্টগুলো কার সেটি জানা যাচ্ছে না। দেশি ও বিদেশি অ্যাকাউন্টের মধ্যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না। গোটা কারবার ডার্কওয়েবে চলায় কোনো ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট থাকছে না। তাই কে টাকা পাঠাল, আর তা কোথায় গেল, তার হদিস পাচ্ছেন না তদন্তকারীরা।
ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এস এম নাজমুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগের তুলনায় দেশে রেমিট্যান্স বেশি আসছে। ব্যাংকিং কিংবা নন-ব্যাংকিং উভয় চ্যানেলেই অর্থ লেনদেনের প্রবাহ বেড়েছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। কোন কোন দেশ থেকে কারা অর্থ পাঠাচ্ছেন, কীভাবে পাঠাচ্ছেন, কারা সেই অর্থ গ্রহণ করছেন, তাদের সব তথ্য বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত আর্থিক লেনদেনের প্রবাহ বেড়েছে। আমরাও আর্থিক লেনদেনের সব চ্যানেলেই গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি।’