মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে মণিপুরি জনগোষ্ঠীর গ্রাম ভানুবিল মাঝের গাঁও। এ গ্রামের বাসিন্দা রাধাবতী দেবী পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে ১৯৭৫ সাল থেকে মণিপুরি তাঁতবস্ত্র তৈরি করছেন।
অতি সম্প্রতি কলার তন্তু থেকে শাড়ি বুনন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে শাড়ি উপহার দেন তিনি। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রাধাবতী দেবী এখন সর্বত্র ও গণমাধ্যমে আলাচনার মূল হয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
মাফলার, ওড়না, শাড়ি, গামছা, ত্রিপিছ বাড়িতেই তৈরি করেন তিনি। কোনো তাঁতবস্ত্র দোকানের চাহিদা আসলেই তিনি সে হিসেবে মণিপুরি তাঁতবস্ত্র তৈরি করে দিতেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নিউজবাংলাকে তিনি জানান, অবিবাহিত রাধাবতী দেবী থাকেন ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বাবার বাড়ি। ছোট ভাই অবসরপ্রাপ্ত মাধমিক শিক্ষক রঞ্জীত সিংহের পরিবারে তিনি সহ ১০ সদস্য। তিনি তাঁতবস্ত্র তৈরি করে সংসার চালাতে ভাইকে সহায়তা করেন। তিনি আদমপুরে তেতইগাঁও রসিদ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন।বাড়িতে টকটকিতে (বড় তাত) মণিপুরি বস্ত্র বুনন করেন। তাঁতবস্ত্র তৈরিতে ১৯৮৬ সালে প্রথম ভারতের মণিপুরের ইম্পলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। এরপর কমলগঞ্জের মাধবপুরে মণিপুরি ললিত কলা একাডেমিতে ২০১০ সালে ২ বার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সেই থেকে তিনি এখন মণিপুরি তাঁতবস্ত্র বুননে এলাকায় একজন প্রসিদ্ধ তাঁতশিল্পী হয়ে উঠেন।
সেখান থেকে বান্দরবনের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরিজি কয়েক মাস আগে খোঁজ করে তাকে নিয়ে যান বান্দরবনে। সেখানে তাকে দেখানো হয় কলাগাছের আশের সুতায় তৈরি ব্যাগ,জুতা,পাপোস,ফুলদানি, ফাইল কভার,কলমদানিসহ হস্তশিল্প সামগ্রী। বলা হয় কলাগাছের সুতা দিয়ে একটি শাড়ি বুনন করে দিতে।প্রথমে সামান্য চিন্তায় পড়ে গেলেও তাঁতে অন্যান্য হস্তশিল্প বুনন সম্ভব হলে শাড়ি কেন সম্ভব নয়, এ প্রশ্ন নিজের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করায় মনের জোরে ও সাহসে তিনি রাজি হয়ে কলাগাছের কিছু সুতা সঙ্গে নিয়ে কমলগঞ্জে নিজ বাড়িতে তাত সুতার সঙ্গে মিশিয়ে প্রথমে একটি ওড়না বুনন করেন।
নিজ বাড়ির তাঁত সঙ্গে নিয়ে বান্দরবন গিয়ে শুরু করেন শাড়ি বুনন। এক কেজি কলার সুতার সঙ্গে তাঁত সুতার সংমিশ্রণ করে টানা ১৫ দিনে কলার সুতার শাড়ি বুনন চমকে দেন সবাইকে। বান্দরবনের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরিজ তার সাফল্যে খুশি হন।রাধাবতী দেবী আরও বলেন, সেখানে কলাগাছের আশের সুতার সরবরাহ প্রচুর বলে সেখানকার ত্রিপুরী তরুণ-তরুণীর প্রশিক্ষণ নিয়ে কলার সুতা দিয়ে ব্যাগ, জুতা, পাপোস, ফুলদানি, ফাইল কভার,কলমদানিসহ হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরি করে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করছে ও বিদেশে রপ্তানি করছে।
বান্দরবনের জেলা প্রশাসক তাকে দিয়ে আরও কয়েকটি শাড়ি বুনন করিয়ে সম্প্রতি সে শাড়িগুলো নিয়ে রাধাবতী দেবী ও তার দলের অন্যান্য নারীদের নিয়ে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে শাড়ি উপহার দিয়েছেন। তিনি সহ দলের অন্যান্যরাও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে উপহার পেয়েছেন। এসময় দেশে কলার সুতার শাড়ি তৈরির একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করার মনোভাব তিনি প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলে জানান।রাধাবতী দেবী এক সময় সিলেট অবস্থান করায় সেখানে মীরা বাজার এলাকায় সমবায় অফিসের তাঁতবস্ত্র বুনেনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখন নিজ এলাকার অনেক মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে বস্ত্র বুনন উদ্যোক্তা বানিয়েছেন। ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁতবস্ত্র মেলায় তিনি মণিপুরি তাঁতবস্ত্র উপস্থাপনও করেছেন।
দেশের জন্য আর কি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি সহায়তায় কলাগাছের সুতায় শাড়ি বুনন শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করার ইচ্ছে আছে। এতে এলাকার, দেশের ও সবার লাভ হবে বলে মনে করেন।রাধাবতী দেবী ঠিক স্পষ্ট বাংলায় কথা বলতে না পারলেও ছোট ভাই রঞ্জীত সিংহ কথা বুঝতে সহায়তা করেন।