রাজশাহীর বাগমারার যুবক আরিফ সুন্দর-সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন সৌদি আরবে। গত সাত মাসে তিনি সেখানে কাজ করে অর্থোপার্জনের মাধ্যমে সেই স্বপ্নের পথে হাঁটতেও শুরু করেছিলেন। জমি বন্দক রেখে বাবা তাকে সৌদি আরব পাঠান। কথা ছিল ধীরে ধীরে সেই টাকা শোধ করে জমি ছাড়িয়ে নেবেন। কিন্তু পরিবারটির সেই স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেল। স্বজনদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে অকালে হারিয়ে গেলেন এই যুবক।
সৌদি আরবে শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি ফার্নিচার ওয়ার্কশপে আগুন লেগে ৯ বাংলাদেশি মারা যান। আহত হন আরও বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে কিং ফাহদ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
দেশটির রাজধানী রিয়াদ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যায় আল-হফুফ শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
আরিফের মতোই বাগমারার আরও তিন পরিবারে চলছে শোকের মাতম। কারণ নিহতদের মধ্যে আরিফসহ চারজনই এই উপজেলার বাসিন্দা।
তারা হলেন- উপজেলার ঝিকড়া ইউনিয়নের বারইপাড়া গ্রামের মো. জমিরের ছেলে মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম, যোগীপাড়া ইউনিয়নের বড় মাধাইমুরি কাতিলা গ্রামের আনিসুর রহমান সরদারের ছেলে ফিরুজ আলী সরদার, বারইহাটি গ্রামের জফির উদ্দিনের ছেলে রুবেল হোসাইন এবং একই গ্রামের শাহাদাত হোসাইনের ছেলে মো. আরিফ। এদের মধ্যে রুবেল ও আরিফ সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা।
রুবেলের ক্ষেত্রে ঘটে গেছে আরেক মর্মস্পর্শী ঘটনা। প্রায় ছয় মাস আগে তার বিয়ে হয়েছিল মোবাইল ফোনে। কিন্তু যার সঙ্গে জীবন বেঁধেছিলেন সেই মরিয়মের সঙ্গে তার আর দেখা হলো না।
আশা ছিল ছুটি পেলে দেশে ফিরবেন। শুরু করবেন সুখের সংসার। কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হলো না।
মরিয়মের মানসিক অবস্থা বলাই বাহুল্য। স্বামী হিসেবে পাওয়া মানুষটিকে তার আর দেখাই হলো না। এই বাস্তবতা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। এখন তার চাওয়া স্বামীর মরদেহটা অন্তত একবার কাছে পাওয়া।
একটি দুর্ঘটনায় একে একে চারজনের মৃত্যুর খবরে বাগমারাজুড়েই শোকের আবহ তৈরি হয়েছে। নিহতদের পরিবারে একদিকে যেমন শোক চলছে, অন্যদিকে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা।
পরিবারগুলো এখন অপেক্ষা করছে কখন স্বজনদের মরদেহ অন্তত তাদের কাছে এসে পৌঁছবে।
সাজেদুলের স্ত্রী রিপা বেগম জানান, কিছুদিন আগেই স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছে তার। এবারের ঈদে আসা হয়নি। তাই সামনের রমজানে বাড়ি আসতে চেয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু স্বামীর আর ফেরা হলো না, ফিরবে তার মরদেহ। এই বলেই কাঁদছেন রিপা বেগম। তাদের মেয়ে সাদিয়া খাতুন বাবার কথা বলছেন আর কাঁদছেন। বাবার পাঠানো উপহার পেয়েছেন গত সপ্তাহে। কিন্তু বাবাকে আর দেখা হলো না তার।
আরিফের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোকে বাবা শাহাদাত হোসাইন বার বার সংজ্ঞা হারাচ্ছেন। দুদিন আগেও ফোন দিয়ে বাবার খোঁজ নিয়েছেন আরিফ। শুক্রবার আবার বাবাকে ফোন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই তার মৃত্যুর খবর আসে বাবার কাছে। আরিফের বাবার এখন একটাই চাওয়া- ছেলের মরদেহটা দ্রুত তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হোক।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ শনিবার রাতে নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তিনি পরিবারের সদস্যদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘যত দ্রত সম্ভব মরদেহ দেশে আনার ব্যাপারে চেষ্টা করা হচ্ছে। আপনাদের এই দুর্দিনে প্রশাসন অবশ্যই পাশে থাকবে।’