বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারী প্রকৌশলী আবু হানিফকে তার কার্যালয় থেকে তুলে নিয়ে মারধর ও লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় বাধা দিতে গিয়ে আহত হয়েছেন দায়িত্বরত এক আনসার সদস্যসহ আরও দু’জন।
বৃহস্পতিবার আহত আনসার সদস্য নিত্যনন্দকে বাগেরহাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার নাক-মুখ ফেটে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র জানায়, বুধবার রাতে শহরের মদনের মাঠ সংলগ্ন অফিসে কাজ করছিলেন উপসহকারী প্রকৌশলী আবু হানিফ। এসময় চারটি মোটরসাইকেলে অন্তত দশজন লোক এসে বকেয়া বিল না দেয়ার অভিযোগে তাকে হুমকি ও গালাগালি করতে থাকে তারা। এসময় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. মনির হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক সরদার নাহিয়ান আল সুলতান ওশান প্রকৌলশলীকে ডেকেছে বলে তাকে হামলাকারীরা তাদের সঙ্গে যেতে বলে। প্রকৌশলী আবু হানিফ যেতে রাজি না হলে তাকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তারা। এসময় অফিসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য নিত্যনন্দ ঠেকাতে গেলে তাকে মেরে নাক-মুখ ফাটিয়ে দেয় তারা। সেসঙ্গে গেট অপারেটর নাইমকেও মারধর করা হয়।
পরে তারা আবু হানিফকে উঠিয়ে শহর রক্ষাবাঁধ-সংলগ্ন বটতলায় নিয়ে যায়। এখানে ছাত্রলীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন বলে সূত্র জানায়।
তারা একটি কাজের বিল না দেয়ার অভিযোগে লাঞ্ছিত করে আবু হানিফকে। পরে খবর পেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের বিষয়টি জানালে ঘণ্টাখানেক পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
এদিকে বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সিসি ক্যামেররার ফুটেজে দেখা যায়, রাত ৯টার কিছু পরে পর্যায়ক্রমে চারটি মোটরসাইকেলে দশজন কার্যালয়ের সামনে মোটরসাইকেল থেকে নামে। এসময় তারা ভেতরে প্রবেশ করে প্রকৌশলী আবু হানিফকে খুঁজতে থাকে। তাকে না পেয়ে উপস্থিত অন্যদের গালাগালি ও হুমকি দিয়ে তারা স্থান ত্যাগ করে।
সিসি ফুটেজে চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের কার্যক্রমে অংশ নিতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে রাতেই বাগেরহাট মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মারধরের শিকার উপসহকারী প্রকৌশলী আবু হানিফ। তবে অভিযোগে কারো নাম দেননি তিনি।
এর কারণ হিসেবে রাতের অন্ধকারে কাউকে চিনতে না পারার কথা বলেছেন আবু হানিফ। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র বলছে, ভয়ে কারও নাম উল্লেখ করেননি তিনি।
হামলায় নাক ফাটিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অফিসের আনসার সদস্য নিত্যনন্দ। ছবি: নিউজবাংলা
উপসহকারী প্রকৌশলী আবু হানিফ বলেন, ‘কাজের চাপ থাকায় অফিসে বসে কাজ করছিলাম। এসময় কয়েকজন ছেলে এসে আমাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। রাজি না হলে মারধর করে জোর করে নিয়ে যায়। ঠেকাতে গেলে অফিসের আনসার ও গেট অপারেটরকেও মারধর করে তারা।
‘আমাকে নিয়ে তারা শহর রক্ষাবাঁধের বটতলায় ঘণ্টাখানেক আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের মতো করে। তারা আমাকে লাঞ্ছিত করার পাশাপাশি গায়েও হাত তুলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের ঠিকাদারি কাজের বিল আটকে রেখেছি কেন- তারা তা জানতে চায়। কিন্তু কোন কাজ বা কিসের বিল- এটা আমি নিজেই সঠিক জানি না।’
তবে ঠিকাদারটি কে?- এমন প্রশ্নের উত্তর দেননি এ প্রকৌশলী। সূত্র বলছে, তিনি সবাইকে চিনলেও অভিযুক্ত সবাই ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হওয়ায় ভয়ে তিনি কারো নাম বলছেন না।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘বুধবার রাত ৯টার দিকে ছাত্রলীগ নামধারী ৮ থেকে ১০ জন মোটরসাইকেল নিয়ে ঢুকে আমার অফিসের উপসহকারী প্রকৌশলী আবু হানিফকে মারধর করেছে। পরে তারা জোর করে তাকে ধরে নিয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘এসময় এক আনসার সদস্যকেও মারধর করে নাক ভেঙ্গে দেয় দুর্বৃত্তরা। সে বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। গেট অপারেটরকেও তারা মেরেছে।
‘পরে উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি জানালে এক পর্যায়ে আবু হানিফকে তারা ছেড়ে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিয়েছি। সিসি টিভি ফুটেজ থেকে দোষীদের সহজেই চিহ্নিত করা যাবে।’
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মনির ও সাধারণ সম্পাদক ওশানের কথা বলে হামলাকারীরা আবু হানিফকে ধরে নিয়ে যায় বলে জানিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘তাদের ঠিকাদারী কাজের বিল নাকি বাকি রয়েছে। কিন্তু উপসহকারী প্রকৌশলী আবু হানিফ তো বিল দেয়ার ক্ষমতা রাখেন না। তারা আমার কাছে আসতে পারত; অভিযোগ থাকলে বলতে পারত। কিন্তু তা না করে সরাসরি অফিসে এসে এভাবে হামলা করবে, এটি মেনে নেয়া যায় না।’
ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশনা ও আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানান তিনি।
এ বিষয়ে বাগেরহাট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সরদার নাহিয়ান আল সুলতান ওশান বলেন, ‘যে প্রকৌশলী অভিযোগ দিয়েছেন তার সঙ্গে আমাদের কিছু লেনদেন ছিল। কয়েকদিন আগে তিনি আমাদের কাছে একটা বড় অংকের টাকা ঘুষ দাবি করেন। কিন্তু ঘুষ দিতে রাজি না হওয়ায়, তিনি আমাদের বিলটি আটকে দেন। কোনো ঠিকাদার যদি তাদের ঘুষ না দেয়, তাহলে তারা ঠিকাদারের বিল আটকে দেন।’
এর সঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলীও জড়িত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গতকাল (বুধবার) তাকে ডেকে শুধু কথা বলা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনই তাকে নিয়ে গেছে। তাকে কোনো মারধর করা হয়নি; জোর করে আনা হয়নি। জোর করে আনলে তিনি তো ৯৯৯ বা পুলিশের সহায়তা নিতে পারতেন বলে দাবি করেন এ ছাত্রনেতা।
বাগেরহাট জেলা পুলিশের মিডিয়া সেলের সমন্বয়কারী ইনস্পেক্টর বাবুল আক্তার বলেন, ‘প্রকৌশলীকে মারধরের বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’