কৃষি নির্ভর মেহেরপুরে এক শ্রেণির জমি লিজ নেয়া চাষিরা অধিক ফলনের আশায় রাসায়নিক সারের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে জমিতে দিচ্ছেন। যা ফসলি জমির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
এতে মাঠে থাকা ফসলকে সাময়িকভাবে তরতাজা করলেও এটি ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হওয়াসহ দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে হুমকির মুখে পড়ছে কৃষি জমি। উর্বর আবাদি জমি হয়ে পড়ছে অনাবাদি।
জমি লিজ দেয়া জমির মালিকরা বলছেন, তাদের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে এক শ্রেণির চাষিরা জমিতে লবণ ব্যবহার করে আবাদি উর্বর জমিকে অনাবাদি বানিয়ে ফেলছেন।
জমি লিজ নেয়া কৃষকরা বলছেন, জমির লিজ খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে কৃষি কাজে ব্যবহৃত সব জিনিসের দাম। তাই স্বল্প সময়ে সব খরচ পুষিয়ে অধিক ফলন পেয়ে লাভবান হওয়ার আশায় তারা জমিতে লবণ ব্যবহার করে থাকেন।
কৃষি বিভাগ জানায়, তারা মাঠ দিবসে কিংবা পরিদর্শনে সবসময় কৃষকদের লবণ ব্যবহার করতে নিষেধ করার পাশাপাশি নিরুৎসাহিত করেন।
যেসব ভুল ধারণা থেকে জমিতে লবণ
জমিতে লবণ ব্যবহার করা কৃষকদের ধারণা, লবণ ব্যবহার করলে ফসলি জমির গাছ তরতাজা হয় সঙ্গে বেশি ফলন পাওয়া যায়। ফসলি জমিতে লবণ ব্যবহার করলে সার ও কীটনাশক কম লাগে।
তারা বলছেন, রসুন-পেঁয়াজ ও বোরো ধানে অধিক ফলনের আশায় রাসায়নিক সারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ২৫ কেজি হারে লবণ ব্যবহার করে থাকেন। ফসলি জমি লাঙল দিয়ে প্রস্তুত করার সময় লবণ ব্যবহার করলে জমিতে কেঁচোর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে, এসব ধারণা ভুল। জমিতে লবণ ব্যবহার বরং ক্ষতিই করে।
লবণ ব্যবহারে জমির যে ক্ষতি
কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, লবণ জমির জন্য বেশ ক্ষতিকর। লবণের কারণে গাছের কচি শিকড়ের মুখ পুড়ে যায়। এতে করে গাছের বৃদ্ধি আটকে যায়। লবণ মাটিতে ক্ষারীয় অবস্থা সৃষ্টি করে, যা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে এবং ফলন বিপর্যয় ঘটায়।
লবণ ব্যবহারের কারণে শিকড় দিয়ে গাছ পুষ্টি নিতে পারে না। ফলে গাছে রোগবালাই বেশি দেখা দেয়। ফসলি জমিতে লবণ প্রয়োগে মাটির গঠন ভেঙে দেয়। গাছ সহজে পানি গ্রহণ করতে পারে না ফলে গাছ মারা যায়। অতি মাত্রায় লবণ ব্যবহারের ফলে ফসলি জমির অনেক উপকারী পোকামাকড় মারা যায়।
জমি লিজ দেয়া গাংনী উপজেলার মটমুড়া গ্রামের মহিবুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব কৃষকদের নিজের জমি নেই অথচ মাঠে চাষাবাদ করে থাকে তাদের কাছে আমার প্রায় পঞ্চাশ বিঘার মত জমি এভারেজ ১৬ হাজার টাকা বিঘা হিসেবে বছর চুক্তিতে লিজ দিয়ে থাকি। এর মধ্যে অনেকেই আবার দীর্ঘমেয়াদি ভাবেও লিজ নিয়ে থাকেন।
‘যারা বছর চুক্তি শেষে জমি ছেড়ে দিয়েছেন, সেই জমি বতর্মানে যারা আবাদ করছেন, সেই জমির কয়েকটিতে লবণ ওঠা শুরু হয়েছে। বর্গা চাষিরা মনে করেন, তারা সাময়িকভাবে লাভবান হলেই চলবে। ভবিষ্যতের কথা ভাবেন না।’
জমি লিজ নেয়া চাষি ওমর ফারুক বলেন, ‘আমি দুই বিঘা জমি ৩২ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য লিজ নিয়েছি। এবার এক বিঘায় ধান ও এক বিঘায় পাটের আবাদ করেছি। আমার মাঠে থাকা প্রায় চার কাঠা জমির পাট মরে শুকিয়ে গেছে। আর ধানের সবুজ পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে।
‘পাশের জমির মালিক আলাদের কাছে শুনছি আগে যে ব্যক্তি এই জমি আবাদ করেছেন তিনি এ জমিতে লবণ ব্যবহার করেছেন। বতর্মানে জমির লিজ খরচ বেশি, তাছাড়া সার থেকে শুরু করে সব জিনিসের দাম বেশি হওয়াই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগের চাষি বাধ্য হয়ে লবণ ব্যবহার করেছেন। সুবিধা নেয়া হয়ে গেছে, জমিও ছেড়ে দিয়েছেন।’
গাংনী উপজেলার উপসহকারী কৃষি অফিসার মো. জাফর কুদ্দুস বলেন, ‘অধিক ফলনের আশায় অন্যান্য সার ব্যবহারের পাশাপাশি জমিতে আয়োডিনযুক্ত লবণ প্রয়োগ করা কোনোভাবে ঠিক নয়।
‘আয়োডিনযুক্ত লবণ সোডিয়াম ক্লোরাইড দিয়ে গঠিত। মাটিতে এর পরিমাণ বেড়ে গেলে বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়। আয়োডিনযুক্ত লবণ জমিতে দিলে সাময়িক ভালো ফল দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে তা জমির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। জমিকে অনুর্বর করে তোলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বেশ কিছু এলাকার পাট ক্ষেতে লোনা ওঠে পাট মরে যাচ্ছে। মূলত আঞ্চলিক ভাষায় এটিকে লোনা ওঠা বা লবণ ওঠা বলে। তবে এর আরেকটি নাম আছে অম্ল বা মাটির এসিডিটি। এটি মূলত জমিতে কোনো এক সময় অধিক মাত্রায় লবণ ব্যবহার করলে এবং পরবর্তীতে যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হয় তাহলে মাটির নিচ থেকে লোনা বের হতে থাকে আর তখন সেই জমিতে থাকা ফসল মারা যায়।’
গাংনী উপজেলার উপসহকারী কৃষি অফিসার মো. জাফর কুদ্দুস বলেন, ‘যেসব জমিতে লবণ ওঠা শুরু হয়েছে সেসব জমিতে পুনরায় উর্বরতা ফিরিয়ে আনতে চাইলে সেসব আক্রান্ত জমিতে লিগিউম জাতীয় ফসল আবাদ করতে হবে। যেমন মাসকলাই, বরবটি ইত্যাদি ফসল মাটিতে নাইট্রোজেন তৈরি করে। আর নাইট্রোজেন মাটির উর্বরতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।’
জেলা কৃষি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শঙ্কর কুমার মজুমদার বলেন, ‘আমরা মাঠ দিবস কিংবা যখন কোনো সেমিনারে যাই তখন চাষিদের সব সময় লবণ ব্যবহার করতে নিষেধ করি। মূলত যাদের নিজস্ব জমি নেই কিন্তু জমি লিজ নিয়ে জমি আবাদ করেন তারাই এমনটি করে থাকেন।’