বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সিন্ডিকেটের কারণে সরকারি গুদামে ধান দিতে পারছে না কৃষক

কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ধান কেনার প্রক্রিয়া ডিজিটাল করা হলেও সেখানেও রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষককের তালিকাতে রয়েছে সিন্ডিকেট চক্রের স্বজনসহ জমি-জমা না থাকা অনেক অকৃষক। উপজেলা ধান সংগ্রহ কমিটির পরোক্ষ যোগসাজশে কৃষককে বঞ্চিত করে সিন্ডিকেট চক্রের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার চিত্র উঠে এসেছে অনুসন্ধানে।

কৃষককে ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে মাঠপর্যায়ে সরকারি গুদামের জন্য ধান সংগ্রহ করা হলেও সরকারের দেয়া সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কুড়িগ্রামের উলিপুরের কৃষক। সিন্ডিকেটের কারণে সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করতে পারছেন না উপজেলার কৃষকরা।

কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ধান কেনার প্রক্রিয়া ডিজিটাল করা হলেও সেখানেও রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষককের তালিকাতে রয়েছে সিন্ডিকেট চক্রের স্বজনসহ জমি-জমা না থাকা অনেক অকৃষক। উপজেলা ধান সংগ্রহ কমিটির পরোক্ষ যোগসাজশে কৃষককে বঞ্চিত করে সিন্ডিকেট চক্রের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার চিত্র উঠে এসেছে অনুসন্ধানে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ৯ জুলাই রোববার দুপুরে উপজেলা খাদ্য গুদাম চত্বরে, প্রায় অর্ধশতাধিক ট্রলি ও ট্রাক্টরে করে ধানের বস্তা নিয়ে অবস্থান করছে ধান ব্যবসায়ীরা। এসময় কোন কৃষকের দেখা পাওয়া যায়নি। মাঠ পর্যায়ে এক থেকে দু’হাজার টাকার বিনিময়ে কৃষকের কাছ থেকে কৃষি কার্ড সংগ্রহ করেন এসব ধান ব্যবসায়ীরা। এসময় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে একাধিক কৃষকের কৃষি কার্ড, এনআইডি ও কৃষকের স্বাক্ষরিত ফাঁকা চেকের পাতা দেখা যায়।

উপজেলা খাদ্য গুদামকে ঘিরে গড়ে ওঠা মিল চাতাল মালিকদের সিন্ডিকেট চক্রের কারণে এসব ব্যবসায়ীদের ধান নিয়মবহির্ভূত হওয়ায় ফেরত পাঠিয়েছে গুদাম কর্তৃপক্ষ।

সিন্ডিকেটের নিম্নমানের ধান নিলেও কৃষকের ধান গুদাম কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ। ছবি: নিউজবাংলা

অভিযোগ উঠেছে, নানা কারসাজির মাধ্যমে ভূমিহীন, দিনমজুর ও অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের লটারিতে বিজয়ী দেখিয়ে তাদের নামে গুদামে ধান দিচ্ছে চক্রটি।

গত রোববার অসাদুপায় অবলম্বন করে ট্রলি ও ট্রাক্টরে ধান গুদামে ঢোকানোর চেষ্টা করলে বিষয়টি জানাজানি হয়। পরে তালিকার সূত্র ধরে উপজেলার ধামশ্রেণী, গুনাইগাছ ও থেতরাই ইউনিয়নসহ পৌরসভা এলাকায় অনুসন্ধান করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, লটারির তালিকায় রয়েছে উপজেলা মিল চাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহফুজার রহমান বুলেটসহ তার পরিবারের একাধিক সদস্যের নাম। তারা হলেন- তালিকার তিন নম্বরে মাহফুজার রহমান বুলেট, ৭৮ নম্বরে বাবা লুৎফর রহমান, দুই চাচা ৭৬ নম্বরে তৈয়বুর রহমান, ৭৭ নম্বরে হাফিজার রহমান এবং দুই ভাই ৭৫ নম্বরে তৈফিক রহমান, ৭৯ নম্বরে ফয়সাল রহমান। এ ছাড়া প্রভাশালী সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যদের স্বজন, প্রতিবেশী, বাড়ির কাজের লোকসহ অনেকেই রয়েছেন তালিকায়।

পৌরসভার মুন্সি পাড়ার বাসিন্দা মাসুদ রানা বলেন, ‘শনিবার রাত ১১টা থেকে আমি ১৫০ বস্তা ধান নিয়ে খাদ্য গুদামে পড়ে আছি। রাত থেকে আমরা অপেক্ষা করলেও গুদাম কর্তৃপক্ষ গেট খোলে না। কিন্তু সকাল বেলা সিন্ডিকেট চক্র আর বড় ব্যবসায়ীরা আসার পর গেট খুলে দেয়া হলো।

‘ব্যবসায়ীদের ধান নিয়ে পরীক্ষা করতেছে। সিন্ডিকেটের সদস্যদের ধান গুদামে নিচ্ছে, অথচ আমাদের ধানের মান খারাপ দেখিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে।’

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট সদস্য আর বড় বড় ব্যবসায়ীরা ছাড়া এখানে কেউ ধান দিতে পারে না। আমাদের চেয়ে খারাপ মানের ধান সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ক্রয় করে গুদামে রেখেছে।’

আর্দ্রতা বেশি থাকায় গুদাম কর্তৃপক্ষ ধান ফিরিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ কৃষকদের। ছবি: নিউজবাংলা

ওই এলাকার বাসিন্দা সেকেন্দার আলী বলেন, ‘আমি দুই হাজার টাকার বিনিময়ে কৃষকের কাছ থেকে কৃষি কার্ড সংগ্রহ করেছি। সেই কার্ড ধরে খাদ্য গুদামে ধান দিতে আসছি। কিন্তু ধান আর্দ্র থাকার অজুহাত দেখিয়ে ট্রলি ফেরত দিলো ওসিএলএসডি।’

তার অভিযোগ, ‘আমার ধানের চেয়ে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নিম্নমানের ধান কিনে গুদামে ভরছে ওসিএলএসডি। শুধুমাত্র সিন্ডিকেট সদস্য না হওয়ায় আজ আমার ধান নিলো না তারা। এখানে যারা ধান নিয়ে আসছে, তাদের কেউ কৃষক নয়। সবাই কৃষকের নিকট হতে কার্ড কিনে ধান দিতে আসছে। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে ধার সংগ্রহ করছে এই খাদ্য গুদাম।’

ট্রলিচালক জহুরুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এর আগেও ব্যবসায়ীদের ধান নিয়ে এসেছি। এখানে কোনো কৃষক ধান দেয়নি। সব বড় বড় ব্যবসায়ীরা ধান দিচ্ছে। আজকে ১৩-১৪ মানের ময়েশ্চারকৃত (আর্দ্র) ধান নিচ্ছে না। অথচ আমি নিজেই এর আগে ১৬-১৭ মানের ময়েশ্চারযুক্ত ধান গুদামে দিয়েছি।’

গুনাইগাছ ইউনিয়নের বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমি এবার ৫০ শতক জমিতে ধান চাষ করে প্রায় ৩০ মণ ধান পেয়েছি। সেখান থেকে কিছু ধান বাজারে বিক্রি করেছি এবং খাওয়ার জন্য কিছু রেখেছি। খাদ্য গুদামে কোনো ধান বিক্রি করিনি। কিন্তু তালিকায় আমার ও আমার পুত্রবধুর নাম কীভাবে আসলো, এটা আমরা বলতে পারি না।’

এ ইউনিয়নের নাগড়াকুড়া টি-বাঁধ এলাকার বাসিন্দা ছাদিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে অগ্রণী ব্যাংকের ওখানে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাকসেসের শিক্ষক ওবায়দুল আমাকে এক হাজার টাকা দিয়ে কৃষি কার্ডটি নেন। এ ছাড়া আমি খাদ্য গুদামে কোনো ধান বিক্রি করিনি। আমার যা ধান ছিল তা বাইরে বাজারে বিক্রি করেছি।’

ধামশ্রেণী এলাকার তালিকাভুক্ত কৃষক পলাশ বলেন, ‘আমি ও আমার মায়ের নাম তালিকায় রয়েছে। ধানও দিয়েছি, টাকাও পেয়েছি।’

কোথায় ধান দিয়েছেন?- প্রশ্নে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে না পেরে সটকে পড়েন।

এ বিষয়ে উপজেলা মিল চাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহফুজার রহমান বুলেটের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। এসময় তিনি বলেন, ‘আমি মিটিংয়ে আছি। পরে এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলব।’ পরে আর ফোন রিসিভ করেননি তিনি।

উপজেলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা (ওসিএলএসডি) শফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, চলতি মৌসুমে আমন-বোরো খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয় গত ১৮ মে। ৩১ আগস্টের মধ্যে সরকার নির্ধারিত ৩০ টাকা কেজি দরে কৃষক-প্রতি তিন টন করে ধান এবং ৪৭ জন চুক্তিকৃত মিলারের নিকট হতে ৪৪ টাকা দরে চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে।

তিনি জানান, এবার উপজেলায় এক হাজার ৯৬০ টন ধান ও এক হাজার ৪৮১ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯ জুলাই পর্যন্ত ৪০২ টন ধান ও এক হাজার ২৪০ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।

তবে তথ্য দিলেও ধান ক্রয়ের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারিভাবে আমন-বোরো ধান বিক্রির জন্য উপজেলা থেকে দু হাজার ১৫৬ জন কৃষক আবেদন করেন। আবেদনকারীদের তালিকা করে কৃষি বিভাগ থেকে উপজেলা খাদ্য বিভাগের নিকট সরবরাহ করা হয়েছে।’

অকৃষক তালিকাভুক্ত হয়েছে কি না- প্রশ্নে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহমুদুল হাছান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কৃষকের তালিকা তৈরি করে কৃষি বিভাগ। সেই তালিকা থেকে লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচিত করেন ইউএনওসহ কৃষক প্রতিনিধিরা। খাদ্য বিভাগ শুধু তালিকা অনুযায়ী নির্বাচিত কৃষকের নিকট থেকে বিধি মোতাবেক ধান সংগ্রহ করে থাকে।’

‘যেহেতু অনিয়মের বিষয়টি জানতে পারলাম, সেটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে’- আশ্বাস দেন তিনি।

এ বিভাগের আরো খবর