কৃষিনির্ভর মেহেরপুরে চলতি মৌসুমে পাট চাষ নিয়ে নানা সমস্যার কারণে উৎপাদন বিপর্যয়ের শঙ্কা পিছু ছাড়ছে না কৃষকদের।
চাষের মৌসুমের শুরুতে দেশব্যাপী দাবদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে তুলনামূলকভাবে পাট উৎপাদন বেড়েছে কম। আর আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ছোট ছোট পাট গাছেই ধরেছে ফুল ও ফল। আবার সেই সঙ্গে মরেছে গাছও। এর মধ্যে বেড়ে ওঠা পাটে শেষ সময়ে এসে দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে চাষিদের ঘরে ওঠার কথা অর্থকরী ফসলটি, কিন্তু এই শেষ সময়ে এসে পাট গাছে তিড়িং পোকার আক্রমণের সঙ্গে যোগ হয়েছে জমির লবণাক্ততা। এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দুর্বল হয়ে মরে যাচ্ছে পাট গাছ। আর বাকিগুলোতে তিড়িং পোকার আক্রমণে পাতাশূন্য হয়ে যাচ্ছে গাছ। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ভুক্তভোগী কৃষকরা।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে মেহেরপুরের গাংনী, মুজিবনগর ও মেহেরপুর সদর উপজেলায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। যদিও এবার চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২০ হাজার হেক্টর জমিতে।
কৃষকরা জানান, পোকার আক্রমণ ও আবাদি জমিতে লবণাক্ততা থেকে রক্ষা পেতে কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও নির্দেশনা মানার পরও মিলছে না সমাধান। ফলে এ বছর অনেকটাই নিশ্চিত ফলন বিপর্যয়ের কারণে পড়তে হবে লোকসানে।
কৃষি বিভাগ জানায়, জেলার সব পাটই প্রায় পরিপক্ব হয়ে গেছে। তারপরও আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এমনটি ঘটছে। এ জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
গাংনী উপজেলার নতুন ব্রজপুর গ্রামের পাটচাষি মিল্টন হোসেন বলেন, ‘এ বছর পাট চাষ করে বিপদে পড়ে গেছি। শুরুর দিকে ছিল প্রচণ্ড রোদ। সঙ্গে ছিল না কোনো বৃষ্টি, যার ফলে পাট উচ্চতায় এমনিতেই দেড় দুই ফিট কমে গেছে।
‘সেচের জন্যও গুনতে হয়েছে বাড়তি খরচ। আর এখন শুরু হয়েছে তিড়িং পোকার আক্রমণ ও পাটের জমির লবণাক্ততা, যে কারণে পাটের উৎপাদন তিন ভাগের এক ভাগই কমে যাবে।’
একই এলাকার আরেক চাষি মুনসুর আলী বলেন, ‘এবার পাট চাষে খরচ বেশি হয়েছে। বিপরীতে পাটের অবস্থা তুলনামূলক খারাপ। তারপরও অধিক পরিচর্যার কারণে মাঠে থাকা পাট কোনোমতে টিকে আছে। আর মাসখানেকের কম সময়ের মধ্যে পাট কাটা শুরু হয়ে যাবে।
‘এ সময় মাটির নিচ থেকে লবণ বের হয়ে জমির অর্ধেক পাট মরে লাল হয়ে শুকাতে শুরু করেছে। সেচ দেয়া বলেন আর কীটনাশক প্রয়োগ করা, কত কিছুই না করলাম, তাতে কোনো লাভ হয়নি। মধ্যে থেকে খরচ করাটাই লস। এবার পাট চাষে করে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।’
তেরাইল গ্রামের পাটচাষি আক্কাস আলী বলেন, ‘এমনিতেই বৃষ্টির অভাবে এবার পাট বুনতে একটু দেরি হয়েছে। তারপরে বেড়েছে কম। আর শেষ সময় পাটক্ষেতগুলোতে হানা দিয়েছে তিড়িং পোকা। পাটের ডগা-কাণ্ড ও পাতা কেটে ফেলেছে পোকাগুলো, যার ফলে মাঠে এ পাট এখনও এক মাস থাকলেও কোনো লাভ হবে না।
‘মণপ্রতি ১০ থেকে ১২ কেজি করে ফলন কমে যাবে। তারপর বতর্মান বাজারে আবার পাটের দাম কম। যেখানে এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করে ফসল ঘরে তুলতে প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হবে, সেখানে সব মিলিয়ে পাট পাওয়া যাবে ১০ থেকে ১২ মণ, যার ফলে এ বছর পাট চাষে করে লোকসানে পড়তে হবে।’
পাট ব্যবসায়ী মহির আলী বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। তা ছাড়া বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা কম থাকায় স্থানীয় বাজারে চাহিদা কমে গেছে পাটের। আমাদের জেলায় অধিকাংশ পাট ব্যবসায়ীর গোডাউনেই রয়েছে পুরোনো পাট। তার ওপর আবার যদি নতুন পাট বাজারে আসে, এমনিতেই পাটের বতর্মান বাজারদর আরও কিছুটা কমে যাবে।’
মেহেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শঙ্কর কুমার মজুমদার বলেন, ‘বর্তমানে জেলার অধিকাংশ পাট প্রায় পরিপক্ব হয়ে গেছে। আর মাসখানেকের মধ্যে পাট কাটা ও জাগ দেয়া শুরু হয়ে যাবে। এ শেষ সময়টিতে মাটির নিচ থেকে লবণাক্ততা বের হওয়ার কারণে অনেক জমির পাট মারা যাচ্ছে।
‘আবার তিড়িং পোকায় পাটের পাতা ও ডগা কাটছে। এ থেকে পাটকে রক্ষার জন্য জেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তা ছাড়া এখন বৃষ্টির সময়। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলে তিড়িং পোকার আক্রমণ ও লবণাক্ততার কারণে পাট মরে যাওয়ার হাত থেকে কৃষকরা রক্ষা পাবে।’
গাংনী উপজেলা উপসহকারী কৃষি অফিসার মো. জাফর কুদ্দুস বলেন, ‘মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বেশ কিছু এলাকার পাট ক্ষেতে লোনা ওঠে পাট মরে যাচ্ছে। মূলত আঞ্চলিক ভাষায় এটিকে লোনা ওঠা বা লবণ ওঠা বলে। তবে এর আরেকটি নাম আছে অম্ল বা মাটির এসিডিটি। এটি মূলত জমিতে কোনো এক সময় অধিক মাত্রায় লবণ ব্যবহার করলে এবং পরবর্তীতে যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হয় তাহলে মাটির নিচ থেকে লোনা বের হতে থাকে আর তখন সেই জমিতে থাকা ফসল মারা যায়।
‘আর যে জমিতে একবার লবণ ওঠা শুরু হয় তা দীর্ঘদিন চলমান থাকে। তাছাড়া বালি মাটিতে অনেক ক্ষেত্রে এ সমস্যাটি এমনিতেই দেখা দেয়। এ থেকে রক্ষা পেতে দীর্ঘদিন ধরে জৈব সারের ব্যবহার করতে হবে এবং জমিতে লবণ ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।’