বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঐতিহ্যের মণ্ডা নিয়ে ক্রেতাদের ক্ষোভ

  •    
  • ৭ জুলাই, ২০২৩ ১৯:২৩

ক্রেতারা জানান, গত তিন বছরে ৫০০ টাকা কেজির মণ্ডা ৬০০ টাকা হয়েছে। এবারের ঈদে তা আরও ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়। এছাড়া মণ্ডা বিক্রির রশিদও কাউকে দেয়া হয় না। এসব কারণে ক্রেতা অসন্তুষ্ট হলেও নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে নিজেদের পকেট ভারী করেছেন মালিকপক্ষ।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী মণ্ডার উদ্ভাবক গোপাল পাল। তার প্রতিষ্ঠিত মণ্ডার দোকানে প্রায় ২০০ বছর ধরে বংশানুক্রমে মণ্ডার ব্যবসা চলছে। ব্যবসায় এখন চলছে পঞ্চম পুরুষ। তবে মণ্ডার দাম নিয়ে বর্তমানে অসন্তুষ্ট ক্রেতারা। তাদের অভিযোগ, মালিকপক্ষ ধাপে ধাপে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ালেও শুধুমাত্র ঐতিহ্যের কারণে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে।

ক্রেতারা জানান, গত তিন বছরে ৫০০ টাকা কেজির মণ্ডা ৬০০ টাকা হয়েছে। এবারের ঈদে তা আরও ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়। এছাড়া মণ্ডা বিক্রির রশিদও কাউকে দেয়া হয় না। এসব কারণে ক্রেতা অসন্তুষ্ট হলেও নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে নিজেদের পকেট ভারী করেছেন মালিকপক্ষ।

বৃহস্পতিবার দুপুরে মণ্ডার দোকানে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে মণ্ডা তৈরি করায় এবং ক্রেতাদের মণ্ডা বিক্রির রশিদ না দেয়ায় দোকানের মালিককে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

বৃহস্পতিবার নানা অনিয়মে ঐতিহ্যবাহী এ দোকানটিকে জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এ ঘটনায় উচ্ছসিত হয় ক্রেতারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেকে ধন্যবাদ জানান তারা। এছাড়াও অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে মণ্ডা তৈরি করে ইচ্ছামতো দামে বিক্রি করায় মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে। অনেকে আবার ঐতিহ্যবাহী এই মণ্ডা না খাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন।

শেক্সপিয়ার মাহমুদ ওয়াকিল হক নামে এক ক্রেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ময়মনসিংহ থেকে কখনও মুক্তাগাছা উপজেলায় গেলে গোপাল পালের মণ্ডার দোকানে যাই৷ দোকানের ভেতরে বেঞ্চে বসেও অনেক সময় কয়েকটি মণ্ডা খাই, আবার কখনও পরিবারের জন্য কিনে বাসায় নিয়ে আসি। মণ্ডা বিক্রির রশিদ তারা কখনওই দেয়না। রশিদ চাইলে ম্যানেজার বাঁকা চোখে তাকিয়ে মণ্ডার গুণগান শুরু করে দেন।’

আসাদুল হক নামে আরেকজন বলেন, ‘দোকানের মালিকসহ ম্যানেজার নিজেদের রাজা-বাদশা মনে করেন। কারণ ইচ্ছেমতো দামে বিক্রি করলেও ভ্রাম্যমাণ আদালত কখনও এ দোকানে অভিযান চালায় না। মণ্ডার একচেটিয়া বিক্রিতে তারা সম্মানিত মানুষদেরও সম্মান দেননা। তাদের ভাব এমন- মণ্ডা বিক্রি করে দোকান থেকে বিদায় করতে পারলেই হলো।’

দোকানটিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযান চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

বছরের পর বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মুখ মিষ্টি করে চলেছে মুক্তাগাছার বিখ্যাত এই মণ্ডা। ছবি: নিউজবাংলা

কাওসার পারভেজ নামের আরেক ক্রেতা বলেন, ‘মণ্ডার স্বাদ আগের মতো নেই। দূর-দূরান্তের ক্রেতারা ঐতিহ্যের কারনে বেশি পরিমাণ মণ্ডা বাড়িতে কিনে নিয়ে যান। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নানা অজুহাতে ধীরে ধীরে দাম বাড়ানো হচ্ছে। তাই দোকানটিতে আর যাই না। কয়েকমাস সবাই এই দোকানের মণ্ডা খাওয়া ছেড়ে দিলেই ন্যয্য দামে বিক্রি করতে বাধ্য হবে মালিকপক্ষ।’

গোপাল পালের ঐতিহ্যবাহী মণ্ডার দোকানটি তার পঞ্চম বংশধর রমেন্দ্র নাথ পালের মৃত্যুর পর বর্তমানে পরিচালনা করছেন তার ছোট ভাই রবীন্দ্রনাথ পাল, রথীন্দ্রনাথ পাল, শিশির কুমার পাল ও মহির কুমার পাল।

নিউজবাংলাকে রবীন্দ্রনাথ পাল বলেন, ‘প্রতি কেজিতে ২০টি মণ্ডা পাওয়া যায়। দুধের ছানা ও চিনি দিয়ে মণ্ডা তৈরি হয়। আমাদের তৈরি মণ্ডার গুণগত মান সেরা হওয়ার কারণেই ক্রেতারা ভিড় জমায়৷ অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে মণ্ডা তৈরি করা হয় না। মণ্ডা তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় মণ্ডার দাম বাড়াতেও বাধ্য হয়েছি। মণ্ডার ঐতিহ্যসহ স্বাদ ধরে রাখতে আমরা বদ্ধ পরিকর।’

উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মণ্ডার দাম বাড়িয়ে দিলেও ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টান্নটির স্বাদ ও গুণগত মান ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর মালিকপক্ষ। ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা

এ বিষয়ে মুক্তাগাছার ইউএনও লুৎফর রহমান আজাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে প্রতি কেজি মণ্ডা ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মণ্ডার এই বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে উৎপাদন খরচের সামঞ্জস্য নেই বলে আমাকে জানিয়েছেন জেলা বাজার কর্মকর্তা।’

ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করে মণ্ডা বিক্রি করলে আবারও ওই দোকানে অভিযান চালানো হবে বলে জানান ইউএনও।

ঐতিহ্যবাহী মণ্ডার ইতিহাস

মুক্তাগাছার মণ্ডার উদ্ভাবক গোপাল পাল ১৮২৪ সালে মণ্ডার দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৭ সালে মারা যান সুস্বাদু মণ্ডার এ উদ্ভাবক।

জনশ্রুতি আছে, গোপাল পাল স্বপ্নে প্রায়ই এক সাধুর দেখা পেতেন। স্বপ্নে সাধু তাকে মণ্ডা তৈরির নিয়ম শেখাতেন। প্রায় রাতেই সাধু মণ্ডা তৈরির নিয়ম বলতেন। এক রাতে মণ্ডা তৈরির শেষ নিয়মটি সাধু তাকে শেখালেন এবং বললেন, ‘তুই এই মণ্ডার জন্য অনেক খ্যাতি অর্জন করবি। তোর মণ্ডার সুখ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।’

গোপাল পাল স্বপ্নে মণ্ডা তৈরির পদ্ধতি পেয়ে মণ্ডা বানিয়ে প্রথমেই খাওয়ান মুক্তাগাছার তৎকালীন জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে। মণ্ডা খেয়ে তৃপ্তি পেয়ে তিনি নিয়মিত তাকে মণ্ডা দিতে বলেন। মহারাজা সূর্যকান্তের ছেলে শশীকান্তও গোপালের মণ্ডা খুব পছন্দ করতেন। সেই থেকে বংশপরম্পরায় মণ্ডা তৈরি করে আসছেন গোপাল পালের উত্তরসুরীরা।

সারা দেশে খ্যাতি থাকলেও মুক্তাগাছার এ ঐতিহ্যবাহী মণ্ডার দোকানটির কোথাও কোনো শাখা নেই। ছবি: নিউজবাংলা

দোকানে থাকা একটি পুস্তিকা থেকে জানা যায়, মণ্ডার কারিগর গোপাল পাল ১৭৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি নিবাস মুর্শিদাবাদে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর মুর্শিদাবাদের লোকজন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বসবাস শুরু করে। তখন গোপাল পালের বাবা রাম পাল প্রাণভয়ে পালিয়ে ভারতের মালদহ হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহীতে চলে আসেন। এরপর সেখান থেকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার তারাটি গ্রামে বসবাস শুরু করেন।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গোপাল পালের বংশধররা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেন। সেখানেও তারা মণ্ডা তৈরি করেন। কিন্তু ভারতের আবহাওয়া মণ্ডা তৈরির জন্য বিশেষ উপযোগী ছিল না। তাই আগের স্বাদ আর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তাগাছায় ফিরে এসে ওই একই স্থানে মণ্ডা তৈরি শুরু করেন তারা। ১০৮ বছর বয়সে ১৯০৭ সালে মারা যান এই মণ্ডার উদ্ভাবক গোপাল পাল।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরাই এ দোকানে বসে মণ্ডা খেয়ে সুনাম করেছেন।

এ বিভাগের আরো খবর