নতুন করে মাইলফলক সৃষ্টি হলো প্রায় আড়াইশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী বগুড়ার দইয়ে। বিখ্যাত এই সরার দই অর্জন করেছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি। এর ফলে নতুন সম্ভাবনার আলো দেখছেন জেলার দই ব্যবসায়ীরা।
তবে গন্তব্যের শেষ এখানেই নয়। বিশ্ববাজারের বগুড়ার দই উপস্থাপন করতে প্রয়োজন আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দর ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল। বিষয়টি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন হলেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়তে পারে বগুড়ার দইয়ের স্বাদ।
২৬ জুন এক সভায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) যাচাই-বাছাই শেষে বগুড়ার দইকে জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন দেয়। বগুড়ার দই ছাড়াও ওইদিন জিআই স্বীকৃতি পায় শেরপুর জেলার তুলসীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া ও আশ্বিনা আম। এ নিয়ে দেশের ১৫টি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেল।
২০১৩ সালে দেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় ডিপিডিটি। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রতিষ্ঠানটি।
কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সাধারণত প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক ও উৎপাদনভিত্তিক পণ্যের জিআই স্বীকৃতি মেলে।
বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য জামদানি শাড়ি। ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর জিআই সনদ পায় এটি। এর আবেদনকারী ও সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। তারপর একে একে স্বীকৃতি পায় ইলিশ, ক্ষীরশাপাতি আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম। এ তালিকায় নতুন করে যুক্ত হলো বগুড়ার দইসহ চার পণ্য। এখন থেকে এসব পণ্য বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি পাবে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বগুড়ার দইয়ের স্বাদ ছড়িয়ে দিতে জেলায় বিমানবন্দর ও ইপিজেড নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ছবি: নিউজবাংলা
বগুড়ার দই জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর উল্লসিত জেলার ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে এই স্বীকৃতি নিয়ে কাজ চলছিল। অবশেষে সেই স্বীকৃতি মিলেছে। ফলে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন হতে যাচ্ছে বগুড়ার দই শিল্পের।
ব্যবসায়ীরা জানান, বগুড়ায় দৈনিক অন্তত এক কোটি টাকার দই বিক্রি হয়। দেশের ভিতরে তারা সব ধরনের সক্ষমতা অর্জন করেছেন। এমনকি স্থানীয় মানুষদের হাতে করে বহু আগেই অল্প-বিস্তর দই বিভিন্ন দেশে গিয়েছে। সেখানে সুনামও কুড়িয়েছে বগুড়ার দই। কিন্তু বানিজ্যিকভাবে বিদেশে পাঠাতে হলে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ- রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেড ও আন্তর্জাতিক মানের বিমান বন্দরের মতো সুবিধাগুলো।
এতে শুধু দই ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন না। এসব সুবিধা পেলে বগুড়া থেকে কৃষি যন্ত্রাংশ, আলুও রপ্তানি হবে। ফলে দেশের অর্থনীতি প্রসারিত হবে।
বগুড়ায় দইয়ের বাজারে সেরার খ্যাতি কুড়িয়েছে এশিয়া সুইটস। মো. নুরুল বাশার চন্দন, নুরুল আলম টুটুল ও নুরুল হুদা তিলক এই তিন ভাইয়ের হাতে গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বগুড়ার দই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় নুরুল বাশার চন্দন বলেন, “দইয়ে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের জন্য ‘গ্রেট অপরচুনিটি’। এর ফলে দই রপ্তানির ক্ষেত্রে আমরা বহুমুখী সুবিধা পাব। কিন্তু এ দইকে বিশ্ববাজারে নিতে হলে সরকারের সহযোগিতা ভীষণ প্রয়োজন।’
কারণ হিসেবে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘দইয়ে সময়ের সীমাবদ্ধতা থাকে। এটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে হয়। তা না হলে দইয়ের স্বাদ ও মান ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। দই দ্রুত পাঠাতে হলে আমাদের অবশ্যই আকাশ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় নিয়ে তারপর তা করতে হলে বিষয়টি সময়সাপেক্ষ হয়ে যাবে। আবার বড় পরিসরে দই উৎপাদনের জন্য এখানে ইপিজেড এলাকাও সৃষ্টি করা প্রয়োজন।’
নুরুল বাশার চন্দন বলেন, ‘কয়েক বছর আগে বগুড়ার সৈয়দ আহম্মেদ কীরণ নামে সিআইপি মর্যাদার এক ব্যবসায়ী নিজ উদ্যোগে এক ট্রাক দই কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল সে দই। আমরা বিশ্বাস করি বিশ্ব বাজারেও আমাদের সেই সক্ষমতা আছে। কিন্তু বিমানবন্দর, ইপিজেড ব্যবস্থা না পেলে আমাদের সেই আউটপুট দেয়াটা দুষ্কর।’
বগুড়ার শতবছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আকবরিয়া হোটেল। দই-মিষ্টিসহ ভোগ্যপণ্যের প্রতিষ্ঠানটি উত্তরাঞ্চলের প্রথম সারিতে রয়েছে।
আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল বলেন, ‘দই অনেক জায়গায় তৈরি হয়। কিন্তু বগুড়ার দই আবহাওয়া ও পানির কারণে সবদিক থেকে আলাদা, যেটি অনেকে জানেন না। জিআই স্বীকৃতির কারণে বিশ্বে বগুড়ার দইয়ের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হলো।’
বানিজ্যিককরণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বগুড়া শহর ও শেরপুর উপজেলা মিলে দিনে অন্তত এক লাখ পিস দই বিক্রি হয়। টাকার অংকে প্রায় এক কোটি হবে। স্বভাবতই রপ্তানি হলে দেশে আরও বেশি রাজস্ব আয় আসবে।
‘আমরা খোঁজ নিয়েছি, ফুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় এ দই দেশের বাইরে পাঠানো সম্ভব। জাহাজে পাঠাতে পারব, তবে বিমানে হলে বেশি ভালো হয়। আমরা তো সবে জিআই পেলাম। এখন উদ্যোগ নেব রপ্তানিতে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের সহযোগিতা দরকার।’
ডিপিডিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা অল্প কিছুদিন হলো জিআই স্বীকৃতি নিয়ে কাজ করছি। আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য, কোনো পণ্য কোনো নির্দিষ্ট এলাকার বলে চিহ্নিত করা। এতে এর বৈশ্বিক স্বীকৃতি মেলে। আরেকটি উদ্দেশ্য, জিআইয়ের মাধ্যমে পণ্যটির বাণিজ্যিকিকরণের পথ সুগম করা। পণ্যটি যখন বাইরের দেশে পাঠানো হয়, তখন জিআই স্বীকৃত পণ্যের মান ও দাম নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে।’
স্বীকৃতি মেলার পর এখনও অনেক কাজ আছে উল্লেখ করে মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখন ইউজার রেজিস্ট্রেশন করার প্রক্রিয়ায় যাব। আর একটা কমন লোগো হবে আমাদের। এটি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো পাবে। লোগোর কাজ চলছে। এটি হয়ে গেলে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যে ব্যবহার করতে পারবে।’
দই ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়ে বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এগুলো নিয়ে আমাদের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে বিমানবন্দরের বিষয়ে বিভিন্ন কোরামে কথা তোলা হয়েছে।
‘এখন চার লেনের মহাসড়কের কাজ চলছে। এরপর রেলের কাজ হবে। একটা একটা করে হোক। এরপর যদি সকল সমীক্ষা শেষে ইতিবাচক থাকলে সরকার বিমানবন্দর দিতে পারে। আর ইপিজেড নিয়ে প্রস্তাবনা দেয়া আছে। সদরের সংসদ সদস্যও এটা নিয়ে চেষ্টা করছেন।’
আড়াইশ বছর আগে শেরপুর উপজেলার ঘোষদের হাতে শুরু হয়ে বগুড়ার দই এখন পেীঁছেছে মুসলিম সম্প্রদায়সহ অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কারখানায়। ছবি: নিউজবাংলা
বগুড়ার দইয়ের ইতিহাস
প্রায় আড়াইশ বছর আগে শেরপুর উপজেলা থেকে বগুড়ার দইয়ের ইতিহাস শুরু হয়। পরবর্তীতে ঘোষদের হাত ধরে ধীরে ধীরে এটি চলে গেছে মুসলিম সম্প্রদায়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের কাছে।
তৎকালীন বগুড়ার শেরপুরের ঘোষ পরিবারের ঘেটু ঘোষ প্রথম দই তৈরি শুরু করেন। টক দই তৈরি থেকে বংশ পরম্পরায় তা চিনিপাতা বা মিষ্টি দইয়ে রূপান্তরিত হয়।
সরার দইয়ের পথিকৃত শেরপুরে ঘোষপাড়ার নীলকণ্ঠ ঘোষ। প্রায় ১৫০ বছর আগে তার হাতেই সরার দই প্রসার লাভ করে।
পরবর্তী সময়ে ১৮ শতকের শেষের দিকে বগুড়ার নওয়াব আলতাফ আলী চৌধুরীর (পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর বাবা) পৃষ্ঠপোষকতায় শেরপুরের ঘোষপাড়ার অন্যতম বাসিন্দা শ্রী গৌর গোপাল পাল বগুড়া শহরে দই উৎপাদন শুরু করেন।
বর্তমানে নওয়াববাড়ি রোডে তার উত্তরসূরি শ্রী বিমল চন্দ্র পাল ও শ্রী স্বপন চন্দ্র পাল ‘শ্রী গৌর গোপাল দধি ও মিষ্টান্ন ভান্ডার’ নামে সেই প্রাচীন বানিজ্য বিতানটি চালু রেখেছেন।