ঐতিহ্যগত ও ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর কুমিল্লায় সিনেপ্লেক্সে বসে চলচ্চিত্র দেখতে চান অনেক সিনেমাপ্রেমী, কিন্তু শহরটিতে সে ব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন ছুটির সময়ে বছরজুড়ে মুক্তি পাওয়া সিনেমা দেখতে পারছেন না তারা।
দূরত্বের কারণে সিনেমা দেখার জন্য কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসাও বাস্তবসম্মত নয় অনেকের কাছে। এমন বাস্তবতায় পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে শহরে সিনেপ্লেক্সে নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন কুমিল্লার বেশ কয়েকজন সিনেমাপ্রেমী।
স্বাধীনতার আগে ও পরে কুমিল্লায় সাত থেকে আটটি হলে নিয়মিত সিনেমা প্রদর্শন হতো। তার মধ্যে মোগলটুলী এলাকায় ‘প্যারাডাইস’ নামে একটি সিনেমা হল ছিল। এ ছাড়াও গাংচর এলাকায় একটি, কান্দিরপাড়ে পিকচার প্যালেস নামে একটি সিনেমা হল ছিল, যেটা ‘লিবার্টি হল’ নামে পরিচিত।
চকবাজারে নয়ন মহল (যেটা এখন ‘রুপালী সিনেমা হল’ নামে পরিচিত), ‘দীপিকা’, ‘দীপালি’ ও ‘রাজগঞ্জের রূপকথা’ সিনেমা হলগুলো ব্যাপক পরিচিত ছিল।
শহরের বাইরে বিভিন্ন উপজেলায় বেশ কয়েকটি সিনেমা হলে দিনে তিনটি করে শো হতো। টিকিট নিয়ে মারামারি হতো। ব্ল্যাকে টিকেট কেটে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার পর নানা গল্প হতো।
সুন্দর পরিবেশ ও ‘সুস্থ ধারার’ সিনেমা তৈরি না হওয়ায় গেল এক দশকে এসব সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দর্শকরা। দর্শকখরায় ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় নগরীর অধিকাংশ সিনেমা হল।
অস্তিত্ব জানান দিতে নগরীর চকবাজারে এখনও রুপালী হলে সিনেমা দেখানো হয়, তবে সেখানে প্রতিদিন ১০ জন দর্শনার্থীও যায় না বলে আফসোস প্রকাশ করেন হল সংশ্লিষ্টরা।
কী বলছেন সিনেমাপ্রেমীরা
গেল কয়েক বছরে দেশে আলোচিত কিছু চলচ্চিত্র তৈরি হলেও পরিবার নিয়ে তা দেখার সুযোগ ছিল না কুমিল্লা শহরবাসীর।
নগরের টমসমব্রিজ এলাকার গৃহবধূ সুমনা হক বলেন, “কান্দিরপাড় দীপিকা সিনেমা হলে আমি আমার বাবার সাথে গিয়ে প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমাটি দেখেছি। অনেক ভালো লেগেছিল। এখন দারুণ দারুণ সিনেমা তৈরি হচ্ছে।
“এ ঈদে সিনপ্লেক্সে বসে ‘প্রিয়তমা’ এবং ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমা দেখার ইচ্ছা ছিল। কুমিল্লায় কোনো সিনেপ্লেক্স না থাকায় তা আর সম্ভব না। ঢাকায় গিয়ে দেখব, সেই সময় কই?”
চিওড়া সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহিবুবুল হক ছোটন বলেন, ‘আমরা যারা পারিবারিক আবহে প্রবেশ করেছি, আমাদের জন্য সিনোপ্লেক্স খুব প্রয়োজন। সন্তান নিয়ে সুস্থ ধারার ছবির সাথে থাকা খুব দরকার।
‘দুই ঘণ্টার ছবির জন্য চার ঘণ্টা জ্যাম ঠেলে ঢাকা গিয়ে সময় ব্যয় অনেক বিলাসী ব্যাপার আজকাল। এই শহরে একটি সিনপ্লেক্স গড়ে উঠুক।’
কুমিল্লা সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক কাজী বেলায়েত উল্লাহ জুয়েল বলেন, ‘আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ চলছে। সালমান শাহ, মান্না, জসিম কিংবা রিয়াজ—এদের ছবি দেখার জন্য কুমিল্লার সিনেমা হলগুলোতে একেবারে হুলুস্থুল লেগে যেত। ঈদের সময় এই আগ্রহ বেড়ে যেত কয়েক গুণ। ভাবতে অবাক লাগে শিক্ষা-সংস্কৃতির শহর হিসেবে খ্যাত এই কুমিল্লায় এখন পরিবার নিয়ে দেখার মতো কোনো সিনেমা হলই নেই।
‘অশ্লীলতার মেঘ সরিয়ে সুস্থ ধারার যে ছবিগুলো এখন তৈরি হচ্ছে, সেগুলো উপভোগ করা থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত হচ্ছে কুমিল্লার মানুষ, যা পরোক্ষভাবে অসুস্থ সংস্কৃতি এবং অসুস্থ সামাজিকতাকে উসকে দিচ্ছে বলে মনে করি।’
একটি বেসরকারি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সময়ে কান্দিরপাড়ের সিনেমা হলগুলোতে ব্ল্যাকের টিকিট বিক্রি করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়া অনেকের জীবনটা কাছ থেকে দেখেছি। বন্ধু তার প্রেমিকা নিয়ে সিনেমা দেখবে। তার নিরাপত্তার জন্য আমরা হলে তার পাশে থেকে সিনেমা উপভোগ করতাম। সত্যি বলতে তখন সিনেমায় কোনো অশ্লীলতা ছিল না।
‘মাঝে একটা খারাপ সময় গেছে। এখন আবার ভালো সময় ফিরে এসেছে। ভালো সিনেমা তৈরি হচ্ছে। আমাদের এখানে সিনেপ্লেক্স খুবই দরকার। এই শহরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি সিনপ্লেক্স তৈরির জন্য বেসরকারি কিংবা ব্যক্তিবিশেষ বিনিয়োগ দরকার।’
বাংলা সিনেমা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেন গৃহবধু মাহজাবিন সুলতানা। নগরীর রেসকোর্স এলাকার এ বাসিন্দা বলেন, “আমি মনে করি গেল কয়েক বছরে বাংলাদেশে বিশ্বমানের সিনেমা তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে ‘মনপুরা’, ‘আয়নাবাজি’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘দেবী’, ‘পোড়ামন-২’, ‘সুলতান’, ‘দহন’, ‘আবার বসন্ত’, ‘পাসওয়ার্ড’, ‘বীর’, ‘মিশন এক্সট্রিম’, ‘শান’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ‘তালাশ’, ‘চোরাবালি’, ‘বিশ্বসুন্দরী’ ও ‘স্বপ্নজাল’-এর মতো সিনেমা তৈরি হয়েছে।
“আমি কিছু সিনেমা ঢাকায় গিয়ে দেখেছি। কয়েকটা দেখেছি মোবাইলে ডাউনলোড করে। তাও সিনেমা মুক্তির মাসখানেক পরে। আফসোস হচ্ছে একটি ভালো সিনেমা হল বা সিনপ্লেক্স না থাকার কারণে কুমিল্লাবাসী এসব সিনেমা উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হলো।”
লেখক ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, “এই শহরে পাকিস্তানি, কলকাতার সিনেমার সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলা সিনেমা চলত। এই জনপদে জন্মগ্রহণ করেছেন কালজয়ী ‘রূপবান’ ছায়াছবির প্রযোজক কামাল উদ্দিন, পরিচালক সালাউদ্দিন। কলকাতার বিখ্যাত পরিচালক সুশীল কুমার এই জনপদের সন্তান। অত্যন্ত শক্তিমান অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জন্মভূমি কুমিল্লা।
“একসময় এই শহরে ভার্নাল থিয়েটার খুব সক্রিয় ছিল। খুব ভালো ভালো নাটক মঞ্চস্থ হতো। সেই সংস্কৃতি এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। ষাটের দশকে কুমিল্লা শহরে যখন ৫০ হাজার মানুষের বসবাস, তখন সিনেমা হল ছিল সাত থেকে আটটা। এখন দশ লক্ষেরও বেশি মানুষের শহরে একটা সিনেমা হল কিংবা একটা সিনে কমপ্লেক্স নেই। আমি খুবই আশ্চর্য হই।”
উত্তরণ কোন পথে
এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। তাদের একজন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব বদরুল হুদা জেনু বলেন, “কুমিল্লা পৌরসভা থাকাকালীন ‘রূপকথা’, ‘লিবার্টি’, ‘রুপালী’, ‘দীপিকা’, ‘দীপালি’ ও ‘মধুমতি’ সিনেমা হল ছিল। রাত-দিন সমানতালে দর্শক আসত। তারপর সিটি করপোরেশন হলো ১০ বছরের বেশি হয়ে গেল। একটা সিনপ্লেক্স নেই।
“এই শহরে অন্তত পাঁচটি সিনপ্লেক্স দরকার। সেখানে একটিও নেই। বিষয়টা ভাবতেই খারাপ লাগে। এখন মানুষের সামর্থ্য বেড়েছে। এই শহরে বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে। আমি বলব যারা বেসরকারিভাবে কুমিল্লায় বাণিজ্যিক ভবন গড়েছেন, তারা চাইলে সিনপ্লেক্স, ফুড কোর্ট ও আবাসিক হোটেল একসঙ্গে একই ভবনে করতে পারেন। তাতে লোকসান হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।”
বদরুল হুদা জেনু আরও বলেন, ‘সিনেপ্লেক্স হলে যারা তরুণ বাবা-মা আছেন, তারা সন্তানদের নিয়ে যেতে পারবেন। পারিবারিক সর্ম্পকটা মজবুত হবে।’