ঈদের দিন কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড়ে মাংসের ভ্রাম্যমাণ হাটে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন অর্ধশত লোক। যারা কোরবানি দিতে পারেন না তারা এখানে আসেন মাংস কিনতে। আর যারা মানুষের বাড়ি গিয়ে মাংস সংগ্রহ করেন তারা এই হাটের বিক্রেতা। এখানে হাতের অনুমানে গরুর মাংস বিক্রি হয়। যুগ যুগ ধরে চলছে মাংস বিক্রির এই হাট। এ হাট বসে বছরে একবারই।
কোলে দুই বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে কান্দিরপাড়ে মাংস কিনতে এসেছেন সুরাইয়া বেগম। মানুষের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। থাকেন শহরতলীর ধর্মপুর এলাকায়। স্বামী মারা গেছেন বছরখানেক আগে। যেসব বাসায় কাজ করেন সেখান থেকে মাঝেমধ্যে এক-আধটু মাংস দেয়। সেটা বাড়ি নিয়ে আসেন। তবে কিনে খেতে পারেন না। আজ প্রায় তিন কেজি মাংস কিনেছেন। সুরাইয়ার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। এই ‘খুশি’ তিনি কান্দিরপাড়ের হাটটি থেকে কিনেছেন।
কুমিল্লা ইপিজেডে শ্রমিকের কাজ করেন মনোয়ার হোসেন। বাসা ভাড়া, এক ছেলের লেখাপড়ার খরচ দিয়ে হাতে তেমন টাকা থাকে না। সেখানে গরুর মাংস কিনে খাওয়া তার কাছে স্বপ্ন। সেই মনোয়ার হোসেন আজ খোশ মেজাজে আছেন। মাত্র দেড় হাজার টাকায় প্রায় সাড়ে ৩ কেজি মাংস কিনেছেন।
মনোয়ার বলেন, ‘কান্দিরপাড় আসার সময় তেল মসলা কিনেছি। এখন গোশত নিয়ে বাসায় যাব। ছেলেটা কয়েকবার ফোন করেছে কখন বাসায় যাব। স্ত্রীকে বলেছি রান্নার আয়োজন করতে। আজ সবাই মিলে গরুর গোশত দিয়ে ভাত খাব।’
ঈদের দিন দুপুর ১২টার দিকে একটি ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হন মইদুর মিয়া। তিনি ভ্যানচালক। নগরীর ডুলিপাড়া এলাকায় একটি ছোট টিনের ঘরে ভাড়া থাকেন। আজ কোনো কাজ নেই। ঘরে বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। সকালে ঘরে পাঙাস মাছ আর ভাত রান্না হয়েছে। দুপুর থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি ঘুরে অন্তত ৮ কেজির মত মাংস সংগ্রহ করেছেন। হাতের ওজনে প্রায় চারকেজি মাংস দুই হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। বাকিটা ঘরে নিয়ে যাবেন।
তার আগে মাংস বিক্রির টাকায় রাজগঞ্জ বাজারে গিয়ে তেল মসলা কিনবেন।
ঈদের দিন দোকান খোলা আছে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে মইদুর বলেন, ‘ভ্যান চালাইয়া আর কয় টেকা পাই। দুইটা পোলা একটা মাইয়া আছে। এডি স্কুলে পড়ে। পোলা মাইয়ার খরচ, ভাত তরকারির খরচ মিল্লা চলতে বহুত কষ্ট হয়। গোশত কিন্না খায়াম এইডা চিন্তাও করি না। আইজ যেডি পাইছি বউরে কয়াম এডির মধ্যে একটু রানতো। আর একটু রাইখা দিতাম কয়াম।’
এই হাটে আসেন নগরীর বিভিন্ন হোটেলের মালিকরা। কম মূল্যে মাংস কিনতে তারাও ভিড় করেন। এই হোটেল মালিকদের কারণে মাংসের দাম বেড়েও যায়।
ছোট একটি ভাতের হোটেল চালান নোমান মিয়া। সাড়ে ৮ হাজার টাকায় তিনি ১৫ কেজি গরুর মাংস কিনেছেন।
নোমান বলেন, ‘আমি ব্যবসায়ী মানুষ। কয়ডা টাকা পাওয়ার জন্য গোশত কিনছি। আরেকটু অপেক্ষা করতাছি। দেহি দামে মিললে আরও কয়েক কেজি কিনমু।’
অনেক মধ্যবিত্তরাও আসেন এই হাটে। কিছুটা কম দামে গরুর মাংস পাওয়ার আশায় তারাও অপেক্ষা করেন। দরদাম করেন। তারপর মাংস কেনে আনন্দে বাড়ি ফেরেন।