কয়েক বছরের পড়ে থাকা প্রায় ২২ কোটি বকেয়া টাকা পাওয়ার আশায় দিনযাপন করছেন বগুড়ার চামড়া ব্যবসায়ীরা। সারা দেশে ঈদুল আজহা উদযাপিত হলেও আনন্দ নেই তাদের মনে। টাকা পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে তাদের।
ব্যবসায়ীদের দাবি, এবার বগুড়া থেকে অন্তত দেড় লাখ চামড়া সংগ্রহ সম্ভব। কিন্তু টাকা না পেলে চামড়া সংগ্রহের এ লক্ষ্যমাত্রায় ঘাটতি দেখা দিবে। এতে চামড়ার বাজারে ধস নামার আশঙ্কাও করছেন জেলার ব্যবসায়ীরা।
বগুড়া চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি জানিয়েছে, সংগঠনটির আওতায় জেলায় ৩০০ চামড়া ব্যবসায়ী আছেন। আড়তদার আছেন ২২ জন। এ ছাড়া আরও কয়েকশ’ জন ফড়িয়া ব্যবসায়ী কাজ করেন চামড়া সংগ্রহের মৌসুম কোরবানির ঈদে।
প্রতি বছর কোরবানি ঈদে ধার-দেনা করে মৌসুমী ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা নগদ টাকায় চামড়া কিনলেও ট্যানারি মালিকদের কাছে তা দিতে হয় বাকিতে। এ কারণে প্রতিবছরই ট্যানারি মালিকদের কাছে টাকা পাওনা থাকছে জেলার চামড়া ব্যবসায়ীদের। তবে করোনা মহামারীর সময়ে সবচেয়ে বেশি টাকা বকেয়া করেন ট্যানারি মালিকরা।
সমিতির তথ্য বলছে, ১৫ ট্যানারি মালিকের কাছে ২১ কোটি ৭৬ লাখ দশ হাজার ১৬৫ টাকা পাওনা হয়ে আছে বগুড়ার ব্যবসায়ীদের। অন্তত ছয় বছর ধরে এই বকেয়া হিসাব জমে আছে। অনেক ব্যবসায়ীর পাওনার সময় আরও বেশি।
ব্যবসায়ী সংগঠনের দাবি, বকেয়া টাকা ও লবণের খরচ মেটাতে না পেরে কয়েক বছরে মূলধন হারিয়ে অন্তত একশ ফড়িয়া ব্যবসায়ী চামড়া কেনাবেচা ছেড়ে দিয়েছেন। মূল ব্যবসায়ীরা মূলধন সংকটে আছেন। কিন্তু ব্যবসা বন্ধ করলে বকেয়া টাকাও ফেরত পাবেন না এমন শঙ্কায় এখনও তা ধরে রেখেছেন অনেক চামড়া সংগ্রহকারী।
বগুড়া শহরের চকসূত্রাপুর এলাকার চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, বগুড়ায় বছরের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয় কোরবানির ঈদে। ঈদকে টার্গেট করে চামড়া ক্রয়-বিক্রয়ের প্রস্তুতি নিয়েছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। কিন্তু গত দুই মৌসুমে চামড়ার অস্বাভাবিক নিম্নমুখী দাম হতাশ করেছে ব্যবসায়ীদের। ট্যানারি মালিকরা সবসময় সিন্ডিকেট করে চামড়া কেনেন এবং দাম পরিশোধের বেলাতেও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অল্প করে টাকা দেন, যা দিয়ে জেলার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা চালাতে পারেন না।
তবে করোনা প্রকোপ কমে যাওয়ার পর এবার চামড়ার দাম কিছুটা বেড়েছে। এতে সেই হতাশা কেটে যেতে পারে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। এখানেও তাদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক বছর ধরে পড়ে থাকা বকেয়া টাকা।
ব্যবসায়ী সূত্র জানায়, বকেয়া টাকার পাশাপাশি লবণের বাড়তি দামে চামড়া সংরক্ষণ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। এখন ৭৪ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা লবণের দাম প্রায় ১ হাজার ৩৩০ টাকা দরে কিনছেন ব্যবসায়ীরা। অথচ গত বছরেও এই দাম ছিল ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা প্রতি বস্তা।
বগুড়ার চামড়া ব্যবসায়ী মো. মুঞ্জুর রহমান ট্যানারি মালিকদের কাছে এক কোটি ৬২ লাখ টাকা পান। টাকা আদায়ে নিয়মিত ধরণা দিচ্ছেন ট্যানারি মালিকদের কাছে। কিন্তু বেশি চাপ দেয়ার সুযোগও নেই তার।
মুঞ্জুর রহমান বলেন, ‘সাত বছর ধরে কয়েকটি ট্যানারি মালিকের কাছে এই টাকা পাই। কিন্তু আমরা চাপ দিতে পারি না তাদের। বেশি চাপ দিলে কোনো টাকাই দিবেন না ট্যানারি মালিকরা। আবার লবণের দামও বাড়তি। এসব সংকটে পড়ে এই ব্যবসা চালাতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। জানা গেছে, চীনারা চামড়া কিনছে। তাই এবার দাম পাওয়ার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।’
আব্দুল হালিম সিদ্দিকী নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘টাকা না পেলে আমরা চামড়া কিনতে পারব না। অথচ তখন সবাই বলবে, আমরাই সিন্ডিকেট করছি। কিন্তু আমাদের মূল সংকট কেউ বুঝবে না। আর সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, লবণের দাম কেজি প্রতি ১০ টাকার মধ্যে যেন সীমাবদ্ধ রাখে।’
লবণের দাম বাড়ায় অনেক ব্যবসায়ী চামড়া সংরক্ষণেও পিছিয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা তার।
বগুড়া চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন সরকারও বলেছেন একই সংকটের কথা। তার নিজেরও প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। প্রতি বছর অল্প কিছু টাকা আদায় করতে পারেন তিনি।
আব্দুল মতিন বলেন, ‘চামড়ার বাজারে বড় ধাক্কা লাগে করোনার সময়ে। এ ছাড়া ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো হেমায়েতপুরে স্থানান্তরের কারণেও আমাদের সংকটে পড়তে হয়েছে। তবে এসব সমস্যা এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে ট্যানারি শিল্প। কিন্তু আমাদের এখন দরকার টাকা।
‘এবার কোরবানির মৌসুমে প্রায় দেড় লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। টাকা না পেলে এই চামড়া সংগ্রহ সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে অনেক ছোট ব্যবসায়ী হারিয়ে গেছে এই ব্যবসা থেকে।’
বকেয়া টাকা সংগ্রহে সমিতির পক্ষ থেকে সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বলে জানান সাধারণ সম্পাদক। এ জন্য তারা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ট্যানারি মালিকদের কাছে থাকা বকেয়া টাকার একটি তালিকা দিয়েছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা হয়েছে। ট্যানারি মালিকদের কাছে থেকে টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে জেলা প্রশাসন।’