‘লসে গরু দেয়ার চেষ্টা করছি, তাও লিচ্ছে না। খামার থেকে চারটা গরু নিয়ে আসছি তিনদিন হলো। একটাও বিক্রি হয়নি।’
বুধবার সকালে রাজধানী গাবতলী পশুহাটে আক্ষেপের সুরে নিউজবাংলাকে কথাগুলো বলছিলেন বগুড়া থেকে আসা প্রান্তিক খামারি মো. রাসেল।
দুটি কালো রঙ্গের ফ্রিজিয়ান ও দুটি শাহীওয়াল গরু এনেছেন তিনি। এবারই প্রথম তিনি গাবতলী পশুহাটে গরু নিয়ে এসেছেন।
তার চারটি গরু যেখানে রেখেছেন সেই জায়গার ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৮০ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এর বাইরে পরিবহন খরচ হয়েছে আরও ২০ হাজার টাকা। গরু চারটি প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার টাকার খাবার খায় বলে জানান মো. রাসেল।
গড়ে ৮০০ মনের ফ্রিজিয়ান দু’টি গরু তিনি এখন ১০ লাখ টাকা হলেই বিক্রি করে দেবেন। এ ছাড়া সাড়ে সাতশ মনের শাহীওয়াল গরুর দাম চাচ্ছেন সাড়ে চার লাখ টাকা করে। অথচ গত তিনদিনে এই অঙ্কের দাম কেউই বলেননি।
তার ভাষ্য, ওই দামে বিক্রি করলেও তার কোনো লাভ থাকবে না।
একই হতাশার কথা শোনান মানিকগঞ্জের খামারি শিবেন চন্দ্র ঘোষ। তিনি বলেন, ‘গতবারের তুলনায় এবারের হাটে গরুর দাম কম।’
শুধু গাবতলী পশুহাট নয়, এবছর রাজধানীর বিভিন্ন পশুহাটে তোলা বড় জাতের গরু ও ছাগল-ভেড়ার দাম অনেক কম বলে জানিয়েছেন খামারিরা।
রাজধানী বসুন্ধরার আবাসিক এলাকার বাসিন্দা শাহ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২৫ কেজি ওজনের ছাগল কিনেছি ১৬ হাজার টাকায়।’ এমন দামে এই ওজনের খাসি কিনতে পেরে তিনি বেজায় খুশি।
তিনবছর ধরে ঈদের আনন্দ নেই শাজাহানের পরিবারে
গাইবান্ধার শাজাহানের পরিবারে তিন বছর ধরে নেই ঈদের আনন্দ। প্রতিবছরই ঈদুল আজহায় তিন ছেলে-মেয়েকে কথা দেন নতুন জামাকাপড় কিনে দিবেন। কিন্তু কোনোবারই তার গরুটি বিক্রি করতে পারেননি। এবারও আছেন নানা শঙ্কায়। এরমধ্যে গতকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি তার দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়েছে।
২০১৮ সালে সাড়ে ৩২ হাজার টাকা দিয়ে গরুটি কেনেন শাজাহান। ৫ বছর ধরে গরুটি লালন-পালন করতে গিয়ে তিনি সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো ঋণ করেছেন। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী (৮ দাঁত বিশিষ্ট) তার গরুটি এলাকায় ‘মিঠু’ নামে পরিচিত।
প্রতিবছরই শাজাহান মিঠুকে বিক্রি করার চেষ্টা করেন; স্বপ্ন দেখেন ঋণ পরিশোধের। কিন্তু তিন বছরেও তার সে স্বপ্ন আলোর মুখ দেখেনি।
বুধবার সকালে যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। শাজাহানের চোখেও মেঘ টলমল; যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গরুটি ৫ বছর ধরে পালছি। ওর লালন-পালন করতে গিয়ে তিন লাখ টাকার বেশি ঋণ করেছি। বাড়িতে তিন ছেলে-মেয়েকে কথা দিয়েছি গরুটি বেঁচতে পারলে এবার ঈদে তাদের নতুন জামাকাপড় কিনে দিব। কিন্তু গরুর দামই বলছেন না কেউ।
‘বাড়িতে পালা ৩৫ মনের ফ্রিজিয়ান গরুটি তিন বছর ধরে বিক্রির চেষ্টা করছি।’
গরুটি নিয়ে তিনি ঢাকা এসেছেন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের জিরাই গ্রাম থেকে। গত চারদিন ধরে গরুটি নিয়ে হাটে আছেন।
বুধবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কেউ দাম বলেনি। আমিও চাইতে সাহস পাইনা।
‘গ্রামের বাড়িতেই এই গরুর দাম ১০ লাখ টাকা বলেছে। দেইনি। আর গাবতলী হাটে এসে কেউ দামই বলছে না। তার ওপর গরু রাখার ভাড়া হিসেবেই গুণতে হচ্ছে ১৮ হাজার টাকা। পরিবহন খরচ গেছে ১২ হাজার টাকা। পাঁচ-সাতজন মিলে প্রতিদিন প্রায় ১৫ শ’ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। গরুর জন্য প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ শ’ টাকার খাবার দিতে হচ্ছে।’
চোখে অন্ধকার দেখছেন নাইম
মানিকগঞ্জের গোলোরা থেকে নিজের বাড়ির গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন নাইম। ৭ মন ওজনের গরুর দাম তার এলাকাতেই উঠেছিল ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু আরও লাভের আশায় গাবতলীতে এসে এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।
নাইম বলেন, ‘মঙ্গলবার থেকে গরুটি নিয়ে বসে আছি। বাঁশের সঙ্গে গরু বাঁধার জন্যই নিয়েছে ২ হাজার টাকা। হাটে দাম উঠেছে এক লাখ পঁয়ষট্টি হাজার টাকা। দাম চাচ্ছি ২ লাখ ১০ হাজার।’
এবারই প্রথম গরু নিয়ে হাটে এসেছেন তিনি। কিন্তু প্রথমবারই এমন অভিজ্ঞতায় কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।
দৌলতপুরের গরু ব্যবসায়ী মো. সুমন শেখ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৫টি গরু নিয়ে এসেছি। বিক্রি করেছি একটি। বৃষ্টি আসলে ছাউনির নিচে বাঁশে গরু বাঁধতে গেলেই টাকা দাবি করছে।’
একাধিক পেশাদার গরু ও মাংস ব্যবসায়ী জানান, এবার ঈদের আগে বৃষ্টির কারণে গরুর দাম কমেছে। যে গরুর দাম দেড় লাখ টাকা ছিল, সেই গরু এখন বিক্রি হচ্ছে এক লাখ ২০ হাজারে।
গাবতলী হাটের কসাই মো. আকবর ও মো. রশীদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্রায় ২০ বছর ধরে কসাইয়ের কাজ করি। এখান থেকেই গরু কিনি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এবারের হাটে গরুর দাম আর উঠবে না।’
তবে ১০০ কেজি বা এর আশপাশে যেসব গরুর ওজন, তুলনামূলক সেসব গরুর দাম পাচ্ছেন খামারি ও গরুর ব্যবসায়ীরা।