নির্বাচনের চিরচেনা আমেজে দেখা যায়নি ‘ছক্কা ছয়ফুর’ কিংবা ‘শাহজাহান মাস্টার’কে। তাদের পক্ষে কোনো পোস্টার, লিফলেট, মিছিল, শোডাউন ছিল না; ছিল না বিপুলসংখ্যক কর্মী। এরপরও দুজনের ঝুলিতে কম পড়েনি ভোট।
বলছি ১৯৯০ সালে সিলেট সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জয়ী ছয়ফুর রহমান বা ‘ছক্কা ছয়ফুর’ এবং সম্প্রতি শেষ হওয়া সিলেট সিটি নির্বাচনে তৃতীয় হওয়া সাধারণ শ্রমজীবী মেয়র প্রার্থী শাহজাহান মিয়া বা শাহজাহান মাস্টারের কথা।
১৯৯০ সালে সিলেট সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছিলেন ছয়ফুর রহমান। তিনি পেশায় সড়কের পাশের একটি ভাঙা রেস্তোরাঁর বাবুর্চি ছিলেন। মাঝেমধ্যে ঠেলাগাড়িও চালাতেন। একেবারে অপরিচিত সাধারণ এ শ্রমজীবীকে ওই বছর বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছিলেন সিলেট সদর উপজেলাবাসী।
হেভিওয়েট প্রার্থীদের হারিয়ে ভোটের মাঠে এমন ছক্কা হাঁকানোতে ছয়ফুর রহমানের নাম হয়ে যায় ‘ছক্কা ছয়ফুর’। এই নামেই তিনি পরিচিতি পান সারা দেশে। তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে সিলেটের বাইরেও।
সম্প্রতি শেষ হওয়া সিলেট সিটি নির্বাচনেও এ ধরনের একজন সাধারণ শ্রমজীবী মেয়র প্রার্থী চমক সৃষ্টি করেন। শাহজাহান মিয়া নামের এ প্রার্থীও পেশাগত জীবনের শুরুর দিকে ছাপড়া রেস্তোরাঁর কর্মচারী ছিলেন। ‘শাহজাহান মাস্টার’ নামেই তিনি বেশি পরিচিত।
মেয়র পদে জিততে না পারলেও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন শাহজাহান মাস্টার। ছক্কা ছয়ফুরের মতো শাহজাহান মাস্টারেরও কোনো পোস্টার, লিফলেট, মিছিল কিংবা শোডাউন ছিল না। বিপুল কর্মীও ছিল না তার।
জনগণের দেয়া অর্থ সহায়তায় বাইসাইকেল চড়ে একা একা প্রচার চালিয়েই ২৯ হাজার ৬৮৮ ভোট পেয়েছেন শাহজাহান। গত বুধবারের নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল পান ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট।
‘গ্লাস বয়’ হিসেবে কাজ শুরু
সাড়ে ৩ হাজার টাকা ভাড়ার বস্তিসদৃশ একটি আধাপাকা দুই কক্ষের ঘরে পরিবার নিয়ে থাকেন শাহজাহান মিয়া। ঘরে আসবাব বলতে তেমন কিছু নেই।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুরমা নদীসংলগ্ন নগরের ঘাসিটুলা মজুমদারপাড়া এলাকার বাসায় গিয়ে আলাপ হয় মেয়র পদে আলোচিত এ প্রার্থীর সঙ্গে।
কথা বলে জানা যায়, ময়মনসিংহ থেকে অভাবের তাড়নায় ২০০২ সালে সিলেট আসেন শাহজাহান। তখন তিনি নিতান্ত কিশোর। সিলেটে এসে নগরের কানিশাইল এলাকার একটি ছাপড়া রেস্তোরাঁয় ‘গ্লাস বয়’ হিসেবে চাকরি শুরু করেন তিনি। গ্লাস বয় মানে গ্লাস ধোয়ামোছার কাজ করা।
রেস্তোরাঁয় কাজ করলেও পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ ছিল শাহজাহানের। তাই কাজের পাশাপাশি ভর্তি হন নগরের ভোলানন্দ নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর ময়মনসিংহ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। আর ২০১৮ সালে সিলেটের মদনমোহন কলেজ থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হন অদম্য এ তরুণ।
এ সময়কালে সিলেটের ৮০টির মতো রেস্তোরাঁয় কাজ করেন শাহজাহান। কাজ করেছেন মোমবাতি কারখানায়ও। এতে একটা বিরাট লাভ হয় শাহজাহানের।
‘অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট ও কারখানায় কাজ করার ফলে শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় হয়। তারাও আমাকে পছন্দ করেন। এই নির্বাচনে তারা আমাকে বিরাট সহায়তা করেছেন’, বলেন শাহজাহান।
মেয়র পদে ৮ প্রার্থীর মধ্যে ‘অর্থ ও সামাজিক মর্যাদায়’ সবচেয়ে পিছিয়ে থাকলেও ব্যতিক্রমী প্রচারের কারণে নজর কাড়েন তিনি।
সঙ্গী ছিল সাইকেল
ছক্কা ছয়ফুরের মতো ব্যতিক্রমী নির্বাচনী প্রচারের মাধ্যমেই প্রথম দৃষ্টি কাড়েন শাহজাহান। সকালেই নিজের বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। একা একা সাইকেল নিয়েই চষে বেড়াতেন নগর; যেতেন ভোটারদের কাছে।
প্রচার সামগ্রী বলতে কেবল লিফলেট। তাও অন্যের টাকায় ছাপানো। সেগুলো তুলে দিতেন ভোটারদের হাতে। ভোট ও দোয়া চাইতেন। এই নিঃসঙ্গ প্রচার চালিয়েই প্রথম নজর কাড়েন শাহজাহান।
নিজের প্রচার সম্পর্কে শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘সকালে সাইকেল নিয়ে বের হতাম আর সন্ধ্যায় ফিরতাম। এই সময়ে যতটা সম্ভব মানুষের কাছে যেতাম। আমার চা নাশতা বা খাওয়ার চিন্তা করতে হতো না। প্রায় সব রেস্টুরেন্টের শ্রমিকরাই পরিচিত। তারা খাওয়াতেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘টাকা-পয়সা না থাকায় ব্যানার পোস্টার করতে পারিনি। লিফলেটও অন্যরা করে দিয়েছেন। নির্বাচনে আমার পকেট থেকে সব মিলিয়ে ২ থেকে ৩ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।’
এখন স্থায়ী কোনো পেশা নেই শাহজাহানের। যখন যা পান, তা করেন। বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ সরবরাহ করে থাকেন। নিজের একটা ফার্মেসিও ছিল, তবে এখন আর নেই।
শাহজাহান জানান, নিজেরই নুন আনতে পান্তা ফুরালেও মানুষের সেবায় পিছপা হন না। কানিশাইল এলাকায় ফ্রি চিকিৎসাকেন্দ্র খুলে গরিব শ্রমজীবীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন। কোচিং সেন্টার খুলে গরিব শিশুদের ফ্রি পড়িয়েছেন। এমনকি করোনার সময় ২০০ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন।
নামে যেভাবে যুক্ত হলো ‘মাস্টার’
নিজের নামের সঙ্গে ‘মাস্টার’ শব্দ যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে শাহজাহান বলেন, ‘সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি আধা সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছি। এ ছাড়া কোচিং সেন্টারে ফ্রি পড়াই। তাই সবাই শাহজাহান মাস্টার ডাকে।’
প্রায় ৩০ হাজার ভোট পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মানুষ মায়া থেকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছেন। তারা আমাকে পছন্দ করেছেন। এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়।’
শাহজাহান বলেন, ‘আমার প্রতীক মানুষ জানত না। আমি একা মানুষ; সবার কাছে যেতে পারিনি। না হলে আরও ভোট পেতাম।’
হতে চেয়েছিলেন এমপি
‘ছক্কা ছয়ফুরের’ মতো শাহজাহান মাস্টারেরও ভোটের নেশা। ছয়ফুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছিলেন। আর শাহজাহান গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে এমপি পদে মনোনয়ন কিনেছিলেন, কিন্তু জমা দিতে পারেননি। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। তখন তা জোগাড় করতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘ছোটকালে পরিকল্পনা ছিল জনপ্রতিনিধি হওয়ার। আমি ছোটবেলায় পড়ালেখার খাতা-কলম কিনতে পারিনি। তাই মানুষের সেবা করার ইচ্ছা আমার সব সময়ের।
‘এ কারণে নির্বাচনে প্রার্থী হই। জনসমর্থন থাকলে আগামীতেও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ রয়েছে।’
ছক্কা ছয়ফুরের মতো শাহজাহান মিয়াও জনগণের ক্ষোভের ভোট পেয়েছেন জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘১৯৯০ সালের উপজেলা নির্বাচনে বড় দলগুলোর প্রার্থী পছন্দ হয়নি ভোটারদের। তা ছাড়া নিরীহ প্রার্থী ছয়ফুরের ওপর হামলা মেনে নিতে পারেননি তারা। এই ক্ষোভ থেকে জনগণ ভোট দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিলেন ছয়ফুরের বাক্স।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবারও শাহজাহান সম্ভবত ক্ষোভের ভোট পেয়েছেন। পছন্দের প্রার্থী না পেয়ে ক্ষুব্ধ ভোটাররা তাকে ভোট দিয়ে থাকতে পারেন। এ ছাড়া বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ভোট বর্জন করলেও তাদের অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী ছিল।
‘ফলে কাউন্সিলর পদে ভোট দিতে এসব দলের অনেকে ভোটকেন্দ্রে এসেছেন। তাদের অনেক ভোটও শাহজাহান মিয়া পেয়ে থাকতে পারেন।’