রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চলন্ত বাস থেকে নূরুন্নাহার আক্তার নামে এক নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এক মাস পার হলেও তার খোঁজ মেলেনি। ২৬ বছর বয়সী ওই নারী সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের খপ্পড়ে পড়েছেন নাকি হত্যার শিকার হয়েছেন তা নিয়েই এখন সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
এদিকে অপহরণের ওই ঘটনায় আশুলিয়া থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ তা নেয়নি। পরিবারের সদস্যরা অবশেষে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে পারলেও সেটির তদন্তে অগ্রগতি নেই।
ভুক্তভোগী নারীর একাধিক স্বজন, পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বালাসী ঘাটের বাসিন্দা নূরুন্নবী ও মিনারা দম্পতির তিন মেয়ের মধ্যে বড় নুরুন্নাহার আক্তারের বিয়ে হয় ফুপাত ভাই বাদশার সঙ্গে। প্রায় ১০ বছর দাম্পত্য জীবন কাটানোর পর গত বছর তাদের বিচ্ছেদ হয়। ৯ বছর বয়সী একমাত্র ছেলেকে দাদীর কাছে রেখে নূরুন্নাহার ঢাকার গাবতলী এলাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। তারপর সেখান থেকে আশুলিয়ার আরেক গার্মেন্টসে চাকরি নেন। থাকতেন বাইপাইল এলাকায়।
গত ১৯ মে শুক্রবার ছুটির দিনে বিকালের দিকে নূরুন্নাহার বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি।
নূরুন্নাহারের চাচা আলম পেশায় একজন মাছ ব্যবসায়ী। থাকেন যাত্রাবাড়ী এলাকায়। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নূরুন্নাহারের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। পরে আশুলিয়ার ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ঘরটির দরোজা খোলা। ঘরের মধ্যে ভাত ও তরকারি রান্না করা। কিন্তু ভাতিজির খোঁজ নেই। প্রতিবেশী এক নারী জানান, সে এক বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।‘
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেয়েটির স্বজনরা আমার কাছে এসেছিলেন। তাদের কাছ থেকে ঘটনা শুনে খোঁজখবর করে প্রাথমিকভাবে কিছু তথ্য পেয়েছি। তাতে আমার মনে হয়েছে মেয়েটি সংঘবদ্ধ কোনো অপরাধ চক্রের হাতে পড়েছে। তবে সে বেঁচে আছে না হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।’
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার ভাষ্য, নূরুন্নাহার দুটি মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করতেন। ফ্রিকোয়েন্টলি দুটি নম্বরে দু’জনের সঙ্গে কথা বলতেন। এদের একজন নারী, আরেকজন পুরুষ। দুজনেরই অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন এলাকায়। তবে তাদের কেউই সম্প্রতি মেয়েটি যে এলাকায় থাকতেন সেখানে যাননি। মেয়েটি নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন আগে একটি ফোন নম্বর ও নিখোঁজ হওয়ার দিন আরেকটি বন্ধ হয়। এতে ধারণা করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে মেয়েটিকে অপহরণ করা হয়েছে।’
নূরুন্নাহারের সাবেক স্বামী বাদশা মিয়া থাকেন গাইবান্ধায়। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘নূরুন্নাহার নিখোঁজ হওয়ার ৫/৬ দিন পর রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার দিকে আমার নম্বরে কল করে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে।
‘ফোন করেই সে বলতে থাকে- আমি তোমার কাছে ফিরে আসতে চাই। আমাকে যদি বাঁচাতে চাও, এখনি ৫শ’ টাকা পাঠিয়ে দাও। আমি ফাঁদে পড়ে গেছি। এক বাসায় ৫দিন আটকে রেখেছে একটি ছেলের সাথে। সেখানে আরও অনেকেই ছিল। তাদের ফাঁকি দিয়ে আমি পালিয়ে এসেছি। ওরা খুঁজছে আমাকে, ধরতে পারলে আমার ভীষণ বিপদ হবে।’
বাদশা মিয়া বলেন, ‘আমি তখন বলেছি, আগে জান বাঁচাও। তারপর দেখা যাবে। এরপর তার মোবাইল ফোনে ৫শ’ টাকা বিকাশ করে পাঠাই। তারও প্রায় ঘণ্টাখানেক পর টাকা তুলে সে বাসে উঠেছিল। বলেছিল যাত্রাবাড়ী যাচ্ছে। বাসের কোনো স্টাফের মোবাইল নম্বর দিয়ে ফোন করে বাসে ওঠার কথা জানায় সে।
‘বেশ কিছুক্ষণ পর ওই নম্বরে বার বার ফোন করলেও কেউ রিসিভ করে নাই। ষষ্ঠবারে গিয়ে একজন ধরে বলে, পর্বতার সামনে থেকে মেয়েটিকে তার স্বামী এসে তুলে নিয়ে গেছে।’
আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ওর যাওয়ার কথা ছিল যাত্রাবাড়ী। সেখানে যাওয়ার আগেই হয়তো অপরাধ চক্রের হাতে সে জিম্মি হয়েছে।’
নূরুন্নাহার বাসে যে নম্বর থেকে বাদশা মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বুধবার নিউজবাংলার পক্ষ থেকে সেই নম্বরে একাধিকবার কল করেও বন্ধ পাওয়া যায়।
পাকিজা এলাকার নিরাপত্তা প্রহরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেয়েটির কথা শুনে ফোন করতে দিয়েছিলাম। তারপর ৫শ’ টাকা আমার নম্বরে আসে। আশপাশে কোথাও ক্যাশআউটের ব্যবস্থা না থাকায় আমার কাছে থাকা চারশ টাকা নিয়েই সে বাসে উঠে গেছে। তারপর কী হয়েছে জানি না।’
মামলা নেয়নি পুলিশ
স্বজনদের অভিযোগ, নূরুন্নাহারকে উদ্ধার করার জন্য তারা একাধিক বার আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে গিয়েও কোনো প্রতিকার মেলেনি। তাকে উদ্ধারের বিষয়ে পুলিশের কেউ আগ্রহী নন। এমনকি জিডি বা মামলা কিছুই হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে ২৩ মে জিডি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি জিডি করা হয়।
জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আব্দুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, মেয়েটির সন্ধানের জন্য দুই থেকে আড়াই হাজার প্রচারপত্র বিলি করেছি। ফরিদপুর ও গাইবান্ধা এলাকায় কিছু তথ্য পেয়েছি। কাজ চলছে।
মামলার বদলে জিডি কেন- এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘মেয়ে তো নিখোঁজ হয়েছে। এটা জিডিই হবে।’