গত বছরের মে ও জুনে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয় সিলেটে। পানিতে তলিয়ে যায় জেলার ৭০ শতাংশ এলাকা। পুরো নগরই পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন জেলার প্রায় সব মানুষ।
বন্যায় বাড়িঘর, সড়ক, কৃষির ক্ষতির পাশাপাশি ব্যাহত হয় স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, ইন্টারেন্ট সেবার মতো জরুরি পরিষেবা।
গত বছরের ভয়াবহতার পর সিলেটে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলায় বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস দেয়া হয় সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে, কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও এসব আশ্বাস বাস্তবায়ন হয়নি। কিছু প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও এখনও তা শেষ হয়নি।
এমন বাস্তবতায় চলতি মাসে সিলেটে আবার বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটে। বাড়ছে নদ-নদীর পানিও। বৃষ্টির সঙ্গে ঢল অব্যাহত থাকায় বন্যার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
গত বছরের মতো বড় বন্যা হলে এবারও কি একই দুর্ভোগ পোহাতে হবে সিলেটবাসীকে? এবার বন্যা মোকাবিলায় কতটুকু প্রস্তুত সিলেট?
এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীর কথায়। বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে রোববার প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। আমাদের কোনো শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে নদীর পানি বেড়ে গেলে আমাদের কিছু করার নেই। তখন পানিতে নগর তলিয়ে যাবে।’
কেন বারবার বন্যা পরিস্থিতি সিলেটে
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সিলেটে প্রধান নদীগুলো, বিশেষত সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, সিলেট নগর ও নগরের আশপাশের এলাকার পুকুর, দীঘি ও হাওর ভরাট ও দখল করে ফেলা এবং সিলেটের উজানে মেঘালয়ে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণেই জেলায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়।
গত বছরের ১৮ মে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি দেখতে এসে সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবুল মোমেনও বন্যার জন্য উল্লিখিত কারণগুলোকেই দায়ী করেন।
মন্ত্রী বলেন, ‘সিলেটে এই মৌসুমে সবসময়ই ঢল নামে। আমাদের ছেলেবেলায়ও এমনটি দেখেছি, কিন্তু তখন পানি আটকে থাকত না; চলে যেত। কারণ আমাদের শহরে অনেক পুকুর ও দীঘি ছিল। প্রত্যেক বাড়ির সামনে পুকুর ছিল। আর সিলেটকে বলা হতো দীঘির শহর, কিন্তু এখন আমরা নগরের ভেতরের সব পুকুর, দীঘি ভরাট করে বড় বড় বিল্ডিং করেছি। হাওরগুলো ভরাট করে ফেলেছি।
‘এ ছাড়া প্রধান নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। খালি মাঠগুলো ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে পানি নামতে পারছে না। যেকোনো দুর্যোগেই সিলেটের জন্য এটা একটা ভয়ের কারণ।’
ওই দিনই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুরমা নদী খননের উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘সিলেটের নদীগুলো খননের ব্যাপারে আমাদের সরকার ও প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক। আমরা নদী খননের পরিকল্পনা নিয়েছি। আগামী বর্ষার আগেই নদীগুলো খনন করতে হবে।’
গত বছরের ২১ জুন সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি দেখতে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সুরমা নদী খননের উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস দেন।
সুরমা নদী খনন কতদূর
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আশ্বাসের পর চলতি বছরে সুরমা নদীর কিছু অংশে খননকাজ শুরু হয়। গত ২১ জানুয়ারি ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কুশিঘাট থেকে লামাকাজি পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার এলাকায় নদী খননকাজের উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ হয়নি। নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় খননকাজ এখন বন্ধ রয়েছে, তবে কেবল মাঝখানের ১৮ কিলোমিটার খনন করে কোনো লাভ হবে না দাবি করে পুরো নদী খননের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশকর্মীরা।
প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। ভারতের বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ এসে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশ করে সুরমা সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্য অনুযায়ী, সুরমার উৎসমুখই ভরাট হয়ে গেছে। এ নদীর উৎসমুখের ৩২ কিলোমিটারে জেগেছে ৩৫টি চর।
বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম বলেন, ‘উজান থেকে ঢলের সাথে বালু ও পলি নামে। তাই নিচের দিক খননের চেয়ে উজানে খনন করা বেশি জরুরি। সুরমার উৎসমুখসহ পুরো নদী একসাথে খনন করা না হলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।’
এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, ‘উৎসমুখ থেকে পুরো নদী খননের জন্য একটি সমীক্ষা চলছে। সমীক্ষার পর ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে। ২০২৪ সালের পরে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।’
তার দাবি, উজানে বেশি বৃষ্টি হলে পুরো নদী খনন করেও কোনো লাভ হবে না।
চলমান খনন প্রকল্প সম্পর্কে এই প্রকৌশলী বলেন, ‘নদী খননকাজ এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এখন নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় কাজ বন্ধ রয়েছে। পানি কমলে আবার খনন শুরু হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।’
হয়নি শহর রক্ষা বাঁধ
গত বছরের ভয়াবহ বন্যার পর এ ধরনের দুর্যোগ থেকে সিলেটকে রক্ষায় ‘শহর রক্ষা বাঁধ’ নির্মাণের দাবি ওঠে। গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রীর সিলেট সফরকালে সিলেট সিটি মেয়রও শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান, তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে রোববার সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ‘শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি সমীক্ষা চালাচ্ছে। সমীক্ষা শেষে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পের আওতায় নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বড় বড় ছড়া-খালগুলো সুরমা নদীর যেসব পয়েন্টে পতিত হয়েছে, সেসব স্থানে স্লুইস গেট নির্মাণ করা হবে।’
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে আসলে আমি সুরমা নদী খনন এবং শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি উত্থাপন করেছিলাম। তিনি বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় দেখবেন বলে কথাও দিয়েছেন। আশা করি প্রধানমন্ত্রী দ্রুত এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।’
বন্যার শঙ্কার মধ্যেই সিলেটে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। আগামী বুধবার এই সিটিতে ভোটগ্রহণ হবে। নির্বাচনের সব প্রার্থীই নির্বাচিত হলে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
ইতোমধ্যে নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেছেন প্রধান দুই প্রার্থী আওয়ামী লীগের মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম বাবুল।
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী তার ইশতেহারের ৩ নম্বর পয়েন্টে উল্লেখ করেছেন, নির্বাচিত হলে নগরকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সুরমা নদী খননে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
নজরুল ইসলাম বাবুলও তার ইশতেহারে উল্লেখ করেছেন, সুরমা নদী খননের ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই করে সরকার যাতে নদী খননের উদ্যোগ নেয়, তার পদক্ষেপ নেয়া হবে। প্রয়োজনে সিটি করপোরেশন শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করবে।
হাসপাতালগুলো আছে আগের অবস্থাতেই
গত বছরের বন্যায় বিভাগের প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ অন্তত ২৪টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বন্যার পানি ঢুকে পড়ে। এতে নষ্ট হয়ে পড়ে এসব হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। অবকাঠামো আর আসবাবপত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বন্যার কারণে ব্যাহত হয় স্বাস্থ্যসেবা। বন্যায় গত বছরের ১৮ জুন বন্ধ থাকে ওসমানী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সেবা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন কেন্দ্র ডুবে যাওয়ায় একদিন অন্ধকারে ছিল পুরো ওসমানী হাসপাতাল।
ওই দুর্যোগের এক বছর পেরিয়ে গেলেও বন্যার সময় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ওসমানী হাসপাতালে নেয়া হয়নি তেমন কোনো ব্যবস্থা। এর মধ্যে গত ১৪ জুনের বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয় ওসমানী হাসপাতাল চত্বরে। ফলে বন্যা দেখা দিলে পরিস্থিতি গত বছরের মতো হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে রোববার ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘বন্যা হলে সবচেয়ে সমস্যা হয় পাওয়ার স্টেশনের কারণে। গতবার পওয়ার স্টেশন ডুবে গিয়ে পুরো হাসপাতাল অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। এটি উঁচু করার একটি উদ্যোগ আমরা নিয়েছিলাম, তবে বরাদ্ধ না আসায় তা সম্ভব হয়নি।
‘আইসিইউ, অপরারেশন থিয়েটার, গাইনি ওয়ার্ডে সেবা যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য আউটডোর ভবনের জেনারেটরের সাথে একটি সংযোগ লাইন করা হয়েছে। ওই জেনারেটরটি অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আছে।’
তিনি বলেন, ‘বন্যার শঙ্কায় নিচ তলার জিনিসপত্রের কিছুটা আমরা ওপরে তুলেছি, তবে সিটি স্ক্যান, এমআরই মেশিনসহ এ রকম কিছু যন্ত্রপাতি ওপরে তোলা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।’
সুখবর নেই বিদ্যুতেও
গত বছরের বন্যায় পানিতে তলিয়ে যায় সিলেটের কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্রসহ বিভিন্ন উপকেন্দ্র। এতে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে পুরো সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবাও বিঘ্নিত হয়।
একে তো বন্যায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, এর মধ্যে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও মোবাইল সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় দেখা দেয় চরম বিপর্যয়। ফলে বিদ্যুতের সাব স্টেশনগুলো উঁচু করার দাবি ওঠে। এ ব্যাপারে কিছু কার্যক্রম শুরু হলেও তা শেষ হয়নি এখনও।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদির বলেন, ‘বন্যায় যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য কুমারগাঁওয়ে গ্যাস ইনস্যুলেটেড সুইচগিয়ার (জিআইএস) প্রযুক্তির সাবস্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। গত অক্টোবরে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, আগামী ডিসেম্বরে যা সম্পন্ন হবে।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পের ভবনের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এতে সাব স্টেশনের সুইচ দোতলায় থাকবে। ফলে বন্যায় ডুবে যাওয়ার শঙ্কা নেই।’
অন্য সাব স্টেশনগুলা দ্রুতই পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বরইকান্দি সাব স্টেশন দোতলা করার কাজ চলছে। বাকিগুলোও ধীরে ধীরে শুরু হবে, তবে বন্যায় বাড়িঘর তলিয়ে গেলে সাবস্টেশন উঁচু করেও লাভ হবে না। বাড়িঘর তলিয়ে গেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতেই হবে।’