বটবৃক্ষের নিচে বসে গা জুড়িয়ে নেয় পথিক। পাখিরা তাকে বানায় আশ্রয়, কিন্তু বৃক্ষটির দেহে যতক্ষণ প্রাণ থাকে, ততক্ষণ হয়তো তার অনুপস্থিতির কথা ভাবে না পথিক কিংবা পাখি। অনেক মানুষের জীবনে বাবার ভূমিকাও প্রশান্তি, আশ্রয়দাতা সেই গাছের মতো, প্রস্থানে যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয় অনেক বেশি।
বিশ্ব বাবা দিবসকে সামনে রেখে জীবনে বাবার ভূমিকার কথা জানিয়েছেন অনেকে। তাদের একজন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা আসিফ মোস্তাফা মিথুন, যিনি চলতি বছরের শুরুতে হারিয়েছেন বাবাকে।
‘জীবিত বাবা আর মৃত বাবার ফারাক আকাশ-পাতাল। জীবিত থাকা অবস্থায় আমি বুঝিনি বাবা আমার কাছে কী ছিল। তখন আমার বাবার কথা তেমন মনেও আসত না। আর এখন সকাল থেকে রাত প্রতিটা ক্ষণে আমার বাবার কথা মনে পড়ে। সবসময় চোখের সামনে বাবার ছবি ভেসে ওঠে’, বলেন মিথুন।
‘আমি ঢাকায় থাকি। আর বাবা থাকতেন জেলা শহরে। বাবা বেঁচে থাকতে ১০-১৫ দিন পরপর তার সঙ্গে আমার মোবাইলে কথা হতো। তখন অনেক দিন আছে তার কথা আমার তেমন মনেও আসত না। আর এখন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাবার কথা মনে পড়ে। আবার ঘুমাতে যাওয়ার সময়ও বাবাকে মনে পড়ে। কোনো কাজ করতে গিয়েও মনে পড়ে। আর যখন ভাবি বাবা আর বেঁচে নেই, বাবাকে আর কোনোদিন দেখব না, তখন বুকের ভেতর কষ্ট বাড়ে। শরীরের বল কমে যায়’, যোগ করেন তিনি।
সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বাবাকে বেশি মনে পড়ে বলে জানান মিথুন। তার ভাষ্য, ‘বাবাকে আমি সবচেয়ে বেশি অনুভব করি যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়। আগে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আমি কোনো চাপ অনুভব করিনি। কারণ আমি জানতাম, বাবা আছে; তিনিই সব সিদ্ধান্ত নেবেন। আর এখন যেকোনো সিদ্ধান্তের আগে মনে সাহস কমে যায়।
‘দশবার ভাবতে হয় এই সিদ্ধান্তটা কি ঠিক হলো? বাবা বেঁচে থাকলে এই বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নিত? আসলে বাবা মারা যাওয়ার পরই বাবার মর্ম বোঝা যায়, কিন্তু তখন কিছু করার থাকে না। এই বোধটা যদি বাবা বেঁচে থাকতে আসত, তাহলে হয়তো বাবাকে আরও বেশি সময় দিতাম।’
‘বাবা ছাতার মতো’
‘বাবা হলো একটা ছাতার মতো, যেটা সবসময় আমার মাথার ওপরে ছিল। সেই ছাতা কখনও আমার মাথায় রোদ-বৃষ্টি পড়তে দেয়নি। সবসময় আমাকে ছায়া দিয়ে গেছে। নিজে খারাপ থাকলেও আমাকে খারাপ থাকতে দেয়নি। এটা বাবা থাকতে বোঝা যায় না। আমি এটা বুঝেছি বাবা মারা যাওয়ার পর।’
নিউজবাংলার কাছে বাবাকে নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পার্থ সারথী বিশ্বাস।
তিনি বলেন, ‘আগে পারিবারিক-ব্যক্তিগত সব সমস্যার সমাধান আসত বাবার কাছে। তিনিই সব সমস্যার সমাধান করত। আমি পরিবারের একমাত্র ছেলে হলেও আমাকে কখনও বুঝতেই দেননি বাবা। আর এখন সব সমস্যার সামাধান আমাকেই করতে হয়। এই সময় অনেক চাপ অনুভব হয় আমার। বাবা যখন ছিল তখন বাবাকে মনে পড়ার কিছু ছিল না। বাবা যে থাকবে না, সেই ফিলটাই তো ছিল না।
‘বাবা জেলায় থাকত। সে সময় কখনও ৫ দিন আবার কখনও ১০ দিন বাবার সাথে হয়তো কথাই হয়নি। অনেক সময় ভুলেই গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে কথা বলার বিষয়টা। শুধু দরকার হলে বাবাকে ফোন দিতাম। অথচ এখন যেকোনো কাজ করতে গেলেই বাবার কথা মনে পড়ে। আর যখন ভাবি বাবা আর কখনোই আসবে না, তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে। চোখে কান্না চলে আসে, কিন্তু ঠিকমতো কাঁদতেও পারি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা আসলে যার বাবা আছে সে বুঝতে পারবে না। আসলে বাবা নিয়ে কথা বলতে গেলে শেষ হবে না। বাবা যখন বেঁচে ছিল, তখন ভয়ে হোক, সংকোচে হোক বাবার কাছ থেকে দূরে থাকতাম। আর এখন মন চায় বাবাকে একটু ছুঁয়ে দেখি। বাবার সামনে একটু দাঁড়াই... জানি বাবা আর কোনো দিন আসবে না...তারপরও...।’
‘আমার বাবা আমার কাছে হিরো’
‘আমার বাবা আমার কাছে হিরো ছিল, তবে সেটা অনুভব করেছি বাবা মারা যাওয়ার পর। বাবা হয়তো নিজে হেরে গেছে অনেকবার, কিন্তু আমাকে কখনোই হারতে দেয়নি। সবসময় আমার সাফল্য কামনা করে গেছে। এক কাপড়ে পার করেছেন কয়েক বছর। নিজে কাপড় না কিনে আমাকে কিনে দিয়েছে। রিকশা ভাড়ার ভয়ে হেঁটে চলাফেরা করে খরচ করেছেন আমার পেছনে। এই মানুষটাকে আমি হিরো বলব না তো কাকে বলব?’
প্রয়াত বাবার এমন গল্প বলছিলেন বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত রাসেল মাহমুদ।
তিনি বলেন, ‘বাবা আমাকে দেখলেই বুঝত আমি কেমন আছি। খারাপ থাকলে সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করত যাতে আমি ভালো থাকি। আর এখন আমি অসহায় থাকলেও সেটা দেখার মতো কেউ নেই। এখন বাবাকে খুব করে মনে পড়ে। সবসময় চোখের সামনে বাবার ছবি দেখতে পাই, কিন্তু যখন ভাবি বাবা মারা গেছে, আর কখনোই আসবে না, তখন বুক ফেটে কান্না চলে আসে। তখন মাঝে মাঝে মোবাইল বের করে বাবার নম্বরের দিকে তাকিয়ে থাকি।’
রাসেল আরও বলেন, ‘আসলে আমার কাছে বাবা হলো একটা সাহসের নাম, শক্তির নাম। বাবা থাকলে অনেক কঠিন কাজও করা যায় আর বাবা না থাকলে সবসময় অসহায় লাগে। যাদের বাবা বেঁচে আছেন, তারা ভাগ্যবান। তাদের উচিত বাবাদের খেয়াল রাখা।’