বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘কিসের অবরোধ, টাহা দিবেন সাগরে নামবেন’

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এটি খুবই হতাশাজনক একটি খবর। সরকার দেশের মৎস্য সম্পদের উন্নতির জন্য এই অবরোধ দিলেও তা কিন্তু নষ্ট করছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যবসায়ী, কিন্তু এর ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন উপকূলের জেলে সম্প্রদায়।’

বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে, কিন্তু এর মধ্যেই কিছু ব্যবসায়ী জেলেদের সাগরে নামিয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলে বলেন, ‘সাফ কথা। কিসের অবরোধ? টাহা দিবেন সাগরে নামবেন। টাহা দিবেন না, নামতে পারবেন না।’

তার দাবি, প্রতি ট্রলার থেকে প্রতিদিন ৩০ হাজার টাকা করে দিতে হয় মাছ ব্যবসায়ী নেতাদের। সেটি করলেই ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ শিকার করে তীরে আসা যায়।

অভিযোগের সত্যতা কোস্ট গার্ডের অভিযানে

কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টে ও সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত খবরে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর ও কুয়াকাটা মৎস্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জেলেদের সাগরে নামানোর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছিল। এর সত্যতা মিলে বুধবার রাতে কোস্ট গার্ডের অভিযানে।

ওই রাতে জেলার কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে অভিযান চালিয়ে কোস্ট গার্ড সদস্যরা তিনটি ফিশিং ট্রলার জব্দসহ ৩২ জেলেকে আটক করেন।

কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের গণমাধ্যম কর্মকর্তা কে এম শাফিউল কিঞ্জল জানান, ‘অভয়াশ্রম রক্ষা অভিযান-২০২৩’ উপলক্ষে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নিজামপুর কোস্ট গার্ডের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার এম মতিউর রহমানের নেতৃত্বে বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে অভিযান চালানো হয়। ওই সময় আন্ধারমানিক নদী সংলগ্ন সমুদ্র মোহনায় তিনটি ফিশিং বোট তল্লাশি করে ৩৩০ কেজি বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ জব্দ করা হয়। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ শিকার করেছিল ওই তিনটি ট্রলারে থাকা ৩২ জেলে। এ কারণে তাদেরও আটক করা হয়। এ ছাড়া তিনটি ট্রলার থেকে ১০ লাখ মিটার জাল জব্দ করা হয়।

তিনি আরও জানান, কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা উপজেলা মেরিন ফিশারি কর্মকর্তা আশিক আহমেদের উপস্থিতিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জব্দ হওয়া মাছ ৩১ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। এ ছাড়া তিনটি ট্রলার মালিককে ৩১ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেন। এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ইলিশসহ সামুদ্রিক ৪৭৫ প্রজাতির মাছের অবাধ প্রজননের লক্ষ্যে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই বঙ্গোপসাগরের দেশীয় জলসীমায় সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার।

প্রতি বছরের মতো এবারও কাগজে-কলম আর মিটিং ডেকে এ কার্যক্রম শুরু করেন মৎস্য অফিসসহ সংশ্লিষ্টরা। মূলত এ নিষেধাজ্ঞা মানতে চান না জেলেরা।

গত কয়েক দিন সরেজমিনে দেখা যায়, ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা পটুয়াখালীর উপকূলীয় এলাকায় দৃশ্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে কুয়াকাটার গঙ্গামতি আর লেম্বুরবন এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকলে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। জেলার সাগর মোহনার গভীর ও অগভীর এলাকায় চলছে মাছ শিকার।

কী বলছেন জেলেরা

কয়েকজন জেলের অভিযোগ, আলীপুরের কয়েকজন মৎস্য ব্যবসায়ী ওই এলাকার দুজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সব মহলকে ‘ম্যানেজ করে’ নির্বিঘ্নে মাছ শিকার করছেন। এ জন্য ট্রলারপ্রতি ৩০ হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ী নেতাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৪৫ বছরের এক জেলে বলেন, ‘সরকার অবরোধ দিছে। মোরা মাছ ধউরমুনা, কিন্তু মোগো মালিকের যন্ত্রণায় নামতে বাধ্য হইছি।

‘হুনছি মালিকরা নাকি ৩০ হাজার করে টাহা দিছে নেতাগো (ব্যবসায়ী নেতা)। হেই জন্য মোগো কেউ ধরে না।’

আরেক জেলে বলেন, ‘নাম কইবেন না হ্যারে। মোগো খাইয়া হালাইবে। প্রতিদিন ৩০ হাজার টাহা দেয়া লাগে মানে সাগরে ট্রলার লইয়া গ্যালেই ৩০ দিতে অয়। মাছ পাই বা না পাই, তবে ৩০ হাজার দিলে কেউ ডিস্টাপ করবে না।

‘আর করেও তো না কেউ ডিস্টাপ। এই যে, গত পনের দিন ধইরা মোগো নাহান আরও যে জাইল্লারা যে সাগরে যায় আর আয়, কই কেউ তো হ্যাগো কিছুই কয় না।’

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের ৩৩ কানি এলাকা থেকে গঙ্গামতি সৈকত পর্যন্ত সাগরের গভীর ও অগভীর এলাকায় ফিশিং বোট প্রতিনিয়তই মাছ শিকারে ব্যস্ত থাকে। আবার রাঙ্গাবালী উপজেলার বিভিন্ন সাগর মোহনায়ও জেলেরা মাছ শিকার করছেন।

জাহাজ মারা এলাকায় মাছ শিকার করে গলাচিপায় আনার কথা স্বীকার করে কাঞ্চন আলী বয়াতি নামের এক জেলে বলেন, ‘কিসের অবরোধ? এ তো টাহার খ্যালা। আপনে টাহা দিবেন, সাগরে নামতে পারবেন। টাহা দিবেন না, নামতে পারবেন না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন জেলে দাবি করেন, মালিকের নির্দেশনায় তারা মাছ ধরছেন। সব ধরনের প্রশাসনকে ম্যানেজ করে রেখেছে মালিকপক্ষ। এমনকি এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমকেও চুপ রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জেলেরা আরও জানান, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের দায়িত্ব নিয়েছেন একজন প্রভাবশালী ইউপি সদস্য, প্রশাসনকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব নিয়েছেন আরেক প্রভাশালী ইউপি চেয়ারম্যান এবং মিডিয়া ম্যানেজ করার দায়িত্বে আছেন এক মাছ ব্যবসায়ী। মূলত এ তিনজনই জেলেদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অবৈধভাবে সাগরে তাদের মাছ শিকারে পাঠাচ্ছেন।

‘আব্বায় সাগরে গেছে ট্রলার লইয়া’

৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার শুরুতে যেসব ট্রলার বিভিন্ন ঘাটে বাঁধা ছিল, তার অনেকগুলোকে ঘাটে দেখা যাচ্ছে না। বেশ কিছু চিহ্নিত জেলে কিংবা মাঝিদের খুঁজে পাওয়া যায়নি তাদের বাড়িতে। লতাচাপলি এলাকার এক বাড়িতে গিয়ে এক জেলের নাম ধরে ডাকা হলে ঘরের মধ্য থেকে তার ছেলে বলে, ‘আব্বায় সাগরে গেছে ট্রলার লইয়া, ঘরে নাই।’ কবে আসবে জানতে চাইলে বলে, ‘চাইর-পাঁচ দিন লাগব।’

‘খুবই হতাশাজনক খবর’

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এটি খুবই হতাশাজনক একটি খবর। সরকার দেশের মৎস্য সম্পদের উন্নতির জন্য এই অবরোধ দিলেও তা কিন্তু নষ্ট করছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যবসায়ী, কিন্তু এর ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কিন্তু উপকূলের জেলে সম্প্রদায়।

‘কারণ ৪৭৫ প্রজাতির বংশবৃদ্ধিসহ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যই সরকার এই অবরোধ দিচ্ছেন, কিন্তু অবরোধ চলাকালীন যদি এভাবে মাছ ধরা হয়, তাহলে তো মাছের প্রজনন ঠিকমত হবে না। অর্থাৎ মাছের উৎপাদন কমে যাবে। আর মাছের উৎপাদন কমে গেলে জেলেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এটি জেলেদেরকে বোঝাতে হবে।’

কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জানান, তাদের সমন্বিত অভিযান অব্যাহত আছে। গত ২০ মে থেকে চলমান অবরোধে এ পর্যন্ত ১৫টি ট্রলারের মালিককে জরিমানা করা হয়েছে, যেগুলো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সাগরে মাছ শিকার করছিল। এ ছাড়া তিনটি বরফ কল ও চারটি মাছের আড়তের মালিককেও জরিমানা করা হয়।

আলীপুর মহিপুর মৎস্য বন্দরে ট্রলার কম থাকার কারণ উল্লেখ করে অপু সাহা জানান, অবরোধ শুধু সাগরে, নদীতে নয়, যে কারণে অনেক ট্রলার নদীতে মাছ শিকার করার কারণে এখানে ট্রলারের উপস্থিতি কম। অভিযান অব্যাহত থাকলেও কেউ কেউ চুরি করে রাতের আঁধারে সাগরে গিয়ে মাছ শিকার করছে।

অভিযোগের বিষয়ে জনপ্রতিনিধির ভাষ্য

অভিযোগ অস্বীকার করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৎস‌্য ব‌্যবসায়ী নেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বোট ভোলায় পাঠিয়েছি। সেখানে মেঘনা নদীতে মাছ ধরছে। এখানে যদি ম্যানেজ করে ট্রলার চালানো হতো তাহলে গতকালকেও (শুক্রবার) বরফ কলে মৎস‌্য অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালাতে পারত না। তাহলে কোস্ট গার্ডের অভিযান তো চলমান আছেই।

‘খুটা জাল দিয়ে যারা মাছ ধরেন তারাই আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। আমি এসব কোনো অবৈধ কাজে কখনোই জড়িত ছিলাম না, এখনও জড়িত নাই। আমার কথা যদি কেউ বলে থাকে, তবে সেটি সম্পূর্ণ মিথ‌্যা ও বানোয়াট এবং আমাকে ফাঁসানোর অপচেষ্টা মাত্র।’

অন্য এক জনপ্রতিনিধিকে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি।

এ বিভাগের আরো খবর