বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গাইবান্ধার ‘জ্বীনের আছর’ দেশজুড়ে

  •    
  • ১৩ জুন, ২০২৩ ২২:৪০

দেশের সংবাদ মাধ্যমে প্রায়ই শিরোনাম হয় ‘জ্বীনের বাদশা’ আটকের খবর। এসব ঘটনায় আটক প্রতারকদের বড় অংশেরই ঘাঁটি গাইবান্ধায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এখান থেকে আটক হয়েছে এমন প্রতারক চক্রের অনেক সদস্য। জ্বীনের বাদশা পরিচয়ে সবশেষ ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় উত্তরের এই জেলা থেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে এক প্রতারক।

দেশে ইমো হ্যাকারদের দুর্গ নাটোরে। আবার মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারকদের বড় অংশের অবস্থান মিলেছে ফরিদপুরে। আর জ্বীনের বাদশা সেজে প্রতারণায় জড়িতদের বড় অংশেরই অবস্থান দেশের উত্তরের জেলা গাইবান্ধা। প্রতারক চক্র এখানে অবস্থান করে মোবাইল ফোনে সারাদেশে প্রতারণার জাল বিছিয়ে আসছে।

‘জ্বীনের বাদশা’ আটকের খবর প্রায়শ দেশের সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে উঠে আসে। এসব ঘটনায় আটক প্রতারকদের বড় অংশেরই ঘাঁটি গাইবান্ধায়। ‘জ্বীন-প্রতারণা’ সম্পর্কিত কোনো অভিযোগ পেলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীরও তদন্তের অগ্রভাগে থাকে এই জেলা। তাদের নিয়মিত অভিযানে এখান থেকে আটক হয়েছে এমন প্রতারক চক্রের অনেক সদস্য।

২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘জ্বীনের বাদশা’ নামধারী চার প্রতারককে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বিশ্বনাথপুর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলেন- রায়হান, তুহিন, জিয়াউর ও মিলন দাস।

চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি বুলবুল নামে এমনই এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি গাইবান্ধা জেলার জ্বীনের বাদশা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

১১ মে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে ‘জ্বীনের বাদশা’ পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে সাদ্দাম আলী নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই মাসের ২৬ তারিখ গোবিন্দগঞ্জে সংঘবদ্ধ ‘জ্বীনের বাদশা’ প্রতারক চক্রের দুই সক্রিয় সদস্য মোর্শেদুল ইসলাম ও জাহিদুল ইসলামকে আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়া বেশকিছু স্বর্ণালঙ্কারও উদ্ধার করে পুলিশ।

প্রতারণার শিকার ইয়াসিন (বাঁয়ে); জ্বীনের বাদশা পরিচয়ে ১৩ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নেয়া গাইবান্ধার প্রতারক উজ্জ্বল। ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা

গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নিয়ে প্রতারণা চালিয়ে আসা ‘জ্বীনের বাদশা’ গ্রেপ্তারের এমন খবর অহরহই মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, জ্বীনের বাদশা সেজে প্রতারণার শীর্ষে রয়েছে গাইবান্ধা জেলা। এই জেলার সাদুল্যাপুর ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় কথিত জ্বীনের বাদশার আনাগোনা বেশি।

সবশেষ চলতি মাসেই মোবাইল ফোনে আল্লাহর অলি ও জ্বীনের বাদশাহ পরিচয়ে প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই প্রতারক চক্র। ভুক্তভোগী ৮ জুন ওই ঘটনা উল্লেখ করে রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করেন।

এই মামলার তদন্তে নেমে ৯ জুন রাত ৮টার দিকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তালুককানুপুর এলাকার নারায়ণপুর গ্রাম থেকে এক ‘জ্বীনের বাদশাকে’ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। উজ্জ্বল মিয়া নামের ওই প্রতারকের কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত একটি মোবাইল ফোনও জব্দ করা হয়।

পুলিশ পরদিন তাকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন জানালে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার আদালতে পাঠানো হলে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. সাইফুর রহমান আজাদ নিউজবাংলাকে মঙ্গলবার এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, ‘ইয়াসিন নামে কিশোরগঞ্জের এক বাসিন্দা ৪ এপ্রিল ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় এসে মগবাজারে একটি আবাসিক হোটেলে ওঠেন। ওইদিন রাত ১২টা ১১ মিনিটে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর অলি ও জীনের বাদশাহ পরিচয় দিয়ে ০১৯৪১৮৫৬৬৩৮ নম্বর থেকে ইয়াছিনের মোবাইলে ফোন করেন। অজ্ঞাত ওই ব্যক্তিই গ্রেপ্তার হওয়া প্রতারক উজ্জ্বল।’

সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, ‘কথোপকথনের এক পর্যায়ে উজ্জ্বল ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করাসহ ধর্মীয় নানা বিষয়ে উপদেশ দেয়া শুরু করেন। টার্গেট করা ইয়াসিনের ভেতরে ভয় ও জ্বীনের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের উদ্দেশ্যে তিনি আরও নানা কথা বলে মোটিভেশন চালান।

‘একপর্যায়ে ভিকটিমকে ফাঁদে ফেলে উজ্জ্বল ৭টি জায়নামাজের টাকা বাবদ ৪ হাজার ৭০০ টাকা বিকাশের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন। এরপর ইফতার খরচ বাবদ ইয়াসিন তাকে ১৬ হাজার ৫০০ টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠান।’

পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, টার্গেট ব্যক্তিকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকাপয়সা হাতিয়ে এটা কেবল শুরু। জ্বীনের বাদশা নামধারী এই প্রতারক এরপর ভয় দেখাতে শুরু করেন। মোবাইল ফোনে তিনি ভিকটিমকে ভয় দেখান- টাকা না দিলে তার ও পরিবারের বড় ধরনের ক্ষতি হবে। এরপর স্বর্ণের পুতুলের লোভ দেখিয়ে উজ্জ্বলের বড় ভাই রুবেলের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা এবং তার জ্বীনের স্বর্ণের তিনটি হাঁড়ি ভেঙে গেছে জানিয়ে আরও ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। হাঁড়ির ভেতরের স্বর্ণ জমাট বেঁধে গেছে জানিয়ে ৩ ভরি স্বর্ণের মূল্য বাবদ হাতিয়ে নেয়া আরও ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

এর মধ্যে নগদ ৫ লাখ টাকা নেয়া হয় টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে। বাকি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয় অনলাইন ব্যাংকিং মাধ্যম বিকাশে।

এছাড়া বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ৩ লাখ ৬ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে আদায় করে প্রতারক। পরে নেয়া হয় আরও এক লাখ টাকা।

বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে ইয়াসিনের কাছ থেকে প্রতারক উজ্জ্বল হাতিয়ে নেয় মোট ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর উজ্জ্বলকে এই প্রতারণার কাজে সহায়তা দেয় তার বড় ভাই রুবেল।

বড় ভাইয়ের হাত ধরে প্রতারণায়

পুলিশ জানায়, জ্বীনের বাদশা পরিচয়ে উজ্জ্বল এই প্রতারণায় নামেন বড় ভাই রুবেলের হাত ধরে। প্রায় দেড় বছর আগে তিনি এই পথে পা বাড়ান। আর বড় ভাই রুবেল এভাবে প্রতারণা চালিয়ে আসছেন প্রায় ৩ বছর ধরে।

উজ্জ্বল তার ভাইয়ের কাছ থেকে প্রতারণার কৌশল রপ্ত করেন। বিভিন্ন মোবাইল নম্বর টার্গেট করে এই দুই ভাই নিজেকে আল্লাহর অলি ও জ্বীনের বাদশা পরিচয় দিয়ে নানা প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে বিকাশের মাধ্যমে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেন।

অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, ‘ইমো হ্যাকারদের দুর্গ নাটোরে। মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারকদের বড় অংশ অবস্থান নিয়ে আছে ফরিদপুরে। আর জ্বীনের বাদশা ও আল্লাহর অলি নামধারী প্রতারক বেশি গাইবান্ধায়।’

অপরিচিত কেউ মোবাইল ফোনে যে কোনো ধরনের প্রলোভন দেখালেই লোভের ফাঁদে পা না দেয়ার পরামর্শ দেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

ভুক্তভোগী ইয়াছিন বলেন, ‘আমি ব্যবসা করি। ৪ এপ্রিল ব্যবসায়ের কাজে ঢাকা যাই। হোটেলে অবস্থানকালে গভীর রাতে আমার মোবাইল ফোনে কল করে জ্বীনের বাদশ ও আল্লাহর অলি পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি বিভিন্ন ধর্মীয় কথা বলতে থাকে। আমি সরল মনে তার কথা বিশ্বাস করি। এক সময় আমি বুঝতে পারি যে প্রতারক চক্রের খপ্পড়ে পড়েছি। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রতারক চক্র আমার কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে অনেক টাকা। শেষ পর্যন্ত আমি ঘটনাটা পুলিশকে জানাই।’

যেভাবে টার্গেট করা হয়

পুলিশ জানায়, চক্রটি গভীর রাতে সহজ-সরল মানুষের মোবাইল নম্বরে ফোন করে নানা ধরনের স্পর্শকাতর কথাবার্তা বলে তাদের মাঝে লোভ ও ভীতির সঞ্চার করে। টার্গেট করা ব্যক্তি প্রতারকদের কথার ফাঁদে পড়ে খুইয়ে বসে সর্বস্ব।

প্রতারক চক্র মূলত দৈবচয়ন ভিত্তিতে মানুষকে গভীর রাতে ফোন করে। কথাবার্তার শুরুতেই ওরা বুঝে যায় টার্গেট ব্যক্তির অবস্থান ও মানসিকতা। ওদের কিছু ইনফর্মারও থাকে, যারা ভুক্তভোগীদের বিষয়ে তথ্য দিয়ে প্রতারণায় সহায়তা করে। ক্ষেত্রবিশেষে ইনফরমাররা মোবাইল ফোন নম্বরও যোগাড় করে দেয়।

টার্গেট স্থির করার পর ওরা ভুক্তভোগীর দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করে। উদ্দেশ্য তাকে তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলা। এভাবে ওরা টার্গেট ব্যক্তির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তার ওপর ভয় ও লোভ জাগিয়ে তোলা হয়। এরপর ওরা টার্গেট ব্যক্তির কাছ থেকে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেয়।

ভিকটিম ইয়াসিনকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার ক্ষেত্রেও ইনফরমারদের ভূমিকা ছিল বলে ধারণা পুলিশের। ইয়াসিন নিঃসন্তান। প্রতারক উজ্জ্বল ইয়াসিনকে তার এই দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করে কথা বলেন। তার সন্তান হবে- এমন আশ্বাস দিয়ে প্রতারক তাকে বশে আনে। এরপর তার আবেগের সুযোগ নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে শুরু হয় তার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া।

এ বিভাগের আরো খবর