রাজধানীর খিলক্ষেত বরুয়া বাজারের সবজি ব্যবসায়ী মেছের আলীর মরদেহ উদ্ধার হয় ২৩ মে। মরদেহে আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিল না। এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নাকি হত্যাকাণ্ড তা-ও নিশ্চিত হতে পারছিল না পুলিশ।
ঘটনার মোড় ঘুরে যায় একটি ব্যাগের হদিস পাওয়ার পর। মরদেহ উদ্ধারের পরদিন ঘটনাস্থলের পাশে ওই ব্যাগটি পায় পুলিশ। আর এই ব্যাগের সূত্র ধরেই পুলিশ নিশ্চিত হয় যে এটি হত্যাকাণ্ড। শেষ পর্যন্ত শনাক্ত হয় হত্যাকারী।
মেছের আলী হত্যার ঘটনায় রোববার রাতে রমজান আলী নামে একজনকে শ্রীপুরের মাওনা থেকে গ্রেপ্তার করেছে খিলক্ষেত থানা পুলিশ। আদালতে হত্যার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ক্যান্টনমেন্ট জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ইফতেখায়রুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন।
মামলার তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, খিলক্ষেতের বরুয়া বাজার সংলগ্ন বাসা থেকে ২০ মে রাতে বের হয়ে নিখোঁজ হন মেছের আলী। ২৩ মে বিকেলে বরুয়ার বোয়ালিয়া খাল সংলগ্ন আশিয়ান হাউজিং প্রজেক্টের বালুর চর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মেছের আলীর ছেলে আল আমিন বাদী হয়ে খিলক্ষেত থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেন।
মরদেহে কোনো আঘাতের চিহ্ন না থাকায় এবং প্রকাশ্যে কারও সঙ্গে মেছের আলীর শত্রুতা না থাকায় স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল যে মেছের আলীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এমন ধারণা থেকেই পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা করা হয়নি।
রাজধানীর খিলক্ষেতে বোয়ালিয়া খাল সংলগ্ন আশিয়ান হাউজিং প্রকল্পের বালুর চর থেকে উদ্ধার হওয়া সেই ব্যাগ। ছবি: নিউজবাংলা
ঘটনাস্থল থেকে ব্যাগ উদ্ধার
মরদেহ উদ্ধারের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে সেখানে একটি ব্যাগ পান পুলিশের তদন্তকারীরা। সেই ব্যাগের ভেতরে কাস্তে, কম্বলসহ কিছু কাপড় ও মিনা নামে একজনের জন্ম নিবন্ধন ও টিকা কার্ড পাওয়া যায়।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাগ উদ্ধারের পর মিনা ও তার স্বামী শাহাবুদ্দিনকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, শাহাবুদ্দিন নিজেও একটি ঘটনার শিকার।
হত্যা রহস্যে নাটকীয় মোড়
শাহাবুদ্দিন ও মিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে ক্যান্টনমেন্ট জোনের এডিসি ইফতেখায়রুল ইসলাম জানান, ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন আগে মিনার স্বামী শাহাবুদ্দিন তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় যাওয়ার উদ্যোগ নেন। সে লক্ষ্যে সহজ-সরল এই মানুষটি নারায়ণগঞ্জ থেকে রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আসেন।
রেলওয়ে স্টেশনে বয়স্ক এক লোকের সঙ্গে শাহাবুদ্দিনের কথা হয়। তাকে ভাতিজা সম্বোধন করে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমিও নেত্রকোণায় যাব, চল একসাথেই যাই। আমরা যদি এখানে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করি তাহলে অনেক সময় লেগে যাবে।’
ওই ব্যক্তি বিকল্প রাস্তার কথা বলে শাহাবুদ্দিনকে বাসে করে নিয়ে আসেন কারওয়ান বাজারে। সেখানে তিনি শাহাবুদ্দিনকে চা খাওয়ান। চেতনানাশক মেশানো ওই চা খাওয়ার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন শাহাবুদ্দিন। আর এই ফাঁকে তার সঙ্গে থাকা ব্যাগ ও পকেটে থাকা ৪০০ টাকা নিয়ে পালিয়ে যান ওই বয়স্ক ব্যক্তি। পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় শাহাবুদ্দিন নেত্রকোণায় পৌঁছেন।
শাহাবুদ্দিনের ব্যাগ যেভাবে মেছের আলীর মরদেহের পাশে
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, প্রযুক্তির সহায়তায় ওই বয়স্ক ব্যক্তির সন্ধান পায় পুলিশ। তার নাম রমজান আলী। থাকেন গাজীপুরের শ্রীপুরে। তিনি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে চা বা অন্যান্য খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে ছিনতাই করেন। কয়েক বছর ধরে এই কাজ করে আসছিলেন তিনি।
খিলক্ষেতের বরুয়া বাজার ও মেছের আলীকে যেখানে পাওয়া যায় সেই এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০ মে একজন বয়স্ক লোক অটোরিকশায় মেছের আলীর সঙ্গে যাচ্ছেন। তার কাঁধে ঝুলানো র্যাক্সিনের একটি ব্যাগ। আর এই ব্যাগের ভেতরে ছিল শাহাবুদ্দিনের ব্যাগটি, যা ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়।
ব্যাগের মধ্যে থাকা মিনা নামে এক নারীর জন্ম নিবন্ধন কার্ডের সূত্র ধরে খু্ঁজে বের করা হয় তার স্বামী শাহাবুদ্দিনকে। এই দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রযুক্তির সহযোগিতায় পুলিশ পায় রমজানের তথ্য।
এডিসি ইফতেখায়রুল বলেন, ‘এই দুটি ঘটনা একই ব্যক্তি ঘটিয়েছে নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা শ্রীপুর থেকে রমজান আলীকে গ্রেপ্তার করি। তিনি মেছের আলীকে চেতনানাশক খাইয়েছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘রমজান আলী মেছের আলীকে চেতনানাশক খাইয়ে তার কাছে থাকা টাকাপয়সা নিয়ে চম্পট দেয়। অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকা মেছের আলী অতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগে মারা গেছেন কিনা তা ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
চার হাজার টাকার লোভে মেছের আলীকে হত্যা
শাহাবুদ্দিনের মতো মেছের আলীকেও টার্গেট করে চেতনানাশক খাইয়ে তার কাছে থাকা ৪ হাজার টাকা নিয়ে যান রমজান।
তাকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে এডিসি ইফতেখায়রুল জানান, মেছের আলী নিখোঁজের দিন রমজানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মেছের আলীর সবজির ভ্যানে বসেই অনেকক্ষণ কথা হয় দুজনের। রাতে বাসা থেকে মেছের আলী বের হয়ে রেলগেটের সামনে আসেন। সেখানে এক জায়গায় বসার পর রমজানা তাকে চা পান করান। চেতনানাশক মেশানো ওই চা পান করার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মেছের আলী। পরে তার কাছে থাকা চার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেহ টেনে নিয়ে বড় বড় ঘাস আছে এমন জায়গায় ফেলে আসেন রমজান।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘মেছের আলীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর রমজান দেখতে পান যে তার কাছে ৪ হাজার টাকা রয়েছে। এই চার হাজার টাকার লোভেই মেছেরকে দেয়া চায়ে চারটি চেতনানাশক বড়ি মিশিয়ে দেন তিনি।
‘মেছের আলীকে ফেলে যাওয়ার সময় রমজান আলী ভুলবশত ওই ব্যাগটি ঘটনাস্থলে ফেলে যান। আর ওই ব্যাগের সূত্র ধরেই আসামিকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়।’