বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের চরম দারিদ্র্য ও মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক ওলিভিয়ার ডি শ্যুটার। এ আইন দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ে বাধা সৃষ্টি করছে জানিয়ে তা বাতিলের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সোমবার বাংলাদেশে ১২ দিনের সফর শেষে রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ওলিভিয়ার ডি শ্যুটার ।
সংবাদ সম্মেলনে ডি শ্যুটার বলেন, ‘সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধী রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার প্রয়োগের কারণে এ আইনের অধীনে তাদের আটক করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যত উন্নয়নের পথে এগুচ্ছে, ততই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স-প্রণোদনা প্রদান ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে।
‘কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দেশটি যে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে কেবল তাদেরই শঙ্কিত করবে না; বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে।’
‘আপনি জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করে, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা বা সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারবেন না’, বলেন তিনি।
বাংলাদেশ গত এক দশকে দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করলেও তা ‘ভঙ্গুর’ অবস্থায় রয়েছে জানিয়ে জাতিসংঘের এ বিশেষ প্রতিবেদক বলেন, ‘সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুবিধা পেতে সাধারণ মানুষকে ঘুষ দিতে হয় বা তাদের রাজনৈতিক সংযোগ থাকতে হয়। এতে সমাজে আয় বৈষম্য বাড়ছে।’
সফরকালে ওলিভিয়ার বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা ভ্রমণ করেন এবং দারিদ্র্যসীমায় থাকা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে সামগ্রিক আয়ের বৈষম্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করলেও, এখনো বহুমাত্রিক দারিদ্র্য রয়ে গেছে এবং বিশেষ করে শহরাঞ্চলে আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।’
‘বাংলাদেশে সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অসম হয়েছে; আদিবাসী, দলিত, বেদে, হিজড়া এবং ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু যেমন- বিহারীদের সুযোগবঞ্চিত করা হয়েছে। সরকার উন্নয়নের নামে অনানুষ্ঠানিক বসতিগুলোতে উচ্ছেদ চালিয়েছে। এক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে বা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন প্রদান না করে বাসস্থানের অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।’
নতুন ধরনের এক দরিদ্র শ্রেণি উত্থিত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এগুলো এমন পরিবার যারা দারিদ্র্যসীমার ঠিক উপরে রয়েছে; তাদের সঞ্চয় নেই। তাই যে কোনো একটি ধাক্কা আসলেই তারা দরিদ্র হয়ে পড়ার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা থেকে প্রত্যাশিত স্তরে উন্নীত হওয়ার পর, একটি দেশের অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে, বাংলাদেশ সরকারকে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে।’
‘মানুষকে দরিদ্রতার মধ্যে রেখে একটি দেশ তার আপেক্ষিক সুফল বা উন্নয়ন ভোগ করতে পারে না। বাংলাদেশের উন্নয়ন মূলত তৈরি পোশাকশিল্পের মতো একটি রপ্তানি খাত দ্বারা ব্যাপকভাবে চালিত যা সস্তা শ্রমের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।’
বাংলাদেকে ২০২৬ সালে এলডিসি মর্যাদা থেকে উন্নীতকরণের সুযোগ ব্যবহার করে, তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরতা কমাতে বিবেচনা করার জন্য আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই শিল্প ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের বর্তমান রপ্তানি আয়ে শতকরা ৮২ ভাগ অবদান রাখছে।’
‘এ খাতে কর্মরতদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, কর্মীদের শিক্ষিত করা, প্রশিক্ষণ দেয়া ও তাদের সামাজিক সুরক্ষায় সরকারকে আরও বেশি সময় ও সম্পদ ব্যয় করা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘এ জাতীয় উদ্যোগ শুধু সুনামের চিন্তা করে এমন বিনিয়োগকারীদেরই আকৃষ্ট করবে না; এটি বাংলাদেশে উন্নয়নের একটি নতুন রূপরেখা তৈরি করবে; যা বৈষম্যমূলক রপ্তানি সুযোগের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ চাহিদা দ্বারা চালিত হবে।’
ডি শ্যুটার সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরো যৌক্তিক করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। একে তিনি ‘অ্যাডহক’ বা সাময়িক ভিত্তিতে ১১৯টি স্কিমের একটি সমন্বিত কর্ম হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
উদ্বেগ প্রকাশ করে ডি শ্যুটার বলেন, ‘বাংলাদেশে কর থেকে প্রাপ্ত আয় ও জিডিপি’র অনুপাত উল্লেখযোগ্য হারে কম হয়েছে (প্রায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ)। সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে অর্থায়নের জন্য প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সরকারি রাজস্ব আসে পরোক্ষ কর থেকে আসলেও প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ।’
‘চিত্রটি উল্টো হওয়া উচিত। গ্রাহকদের নয়; উচ্চ আয়ের মানুষ ও বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জনসাধারণের পরিষেবা ও সামাজিক সুরক্ষার অর্থায়নে অবদান রাখতে হবে।’
জয়লবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে সৃষ্ট নতুন ও নিয়ন্ত্রণের অসামর্থ্য ঝুঁকির বিষয়েও কথা বলেন তিনি। বলেন, ‘শুধুমাত্র ২০২২ সালে, ৭১ লাখ লাদেশি নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং অন্যান্য বিপর্যয়ের কারণে বা জলের লবণাক্তকরণের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে ও তাদের জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হয়।’
এ ধরণের ঝুঁকি থেকে দেশের সাধারণ জনগণকে রক্ষায় সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি তৈরি করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশে ডি শ্যুটারের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কক্সবাজার সফরও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সফরকালে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন তিনি। প্রায় দশ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য জনাকীর্ণ বাংলাদেশের সরকারকে অভিবাদন জানানোর পাশাপাশি আশ্রয়শিবিরের বসবাস-অনুপযোগী অবস্থার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যাবাসনের শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের একটি স্বাচ্ছন্দ্য ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয়েরই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।’
জাতিসংঘের এই বিশেষ প্রতিবেদক জানান, এটি ‘অনভিপ্রেত’ যে ২০২৩ সালে রোহিঙ্গা শিবিরে জরুরি মানবিক প্রয়োজন মোকাবিলায় ৮৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের যৌথ পরিকল্পনার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক দাতারা এতই কম অবদান রেখেছে যে, চাহিদার শতকরা মাত্র ১৭ ভাগ অর্থায়ন জোগাড় হয়েছে। মার্চ ২০২৩ সাল থেকে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে তার খাদ্য ভাউচারের মূল্য প্রতি মাসে ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করতে হয়েছে এবং এটি আগামী জুনে আরও কমিয়ে ৮ ডলার করা হবে।
অপুষ্টি এবং যথেষ্ট পুষ্টির অভাব বৃদ্ধি পাবে, বিশেষ করে শিশুদের পরিণতি ভয়াবহ হবে বলে সতর্ক করেন ডি শ্যুটার।
তার ভাষায়, ‘পরিবারগুলো মরিয়া হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ সরকার যদি রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং মানবাধিকার আইন অনুযায়ী তাদের আয়-উপার্জনের সুযোগ করে দেয়, তবে অন্তত তাদের কিছুটা কষ্ট লাঘব হবে।’
২০২৪ সালের জুনে বিশেষ প্রতিবেদক তার বাংলাদেশবিষয়ক সর্বশেষ প্রতিবেদন মানবাধিকার কাউন্সিলে পেশ করবেন।