গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে গেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লা খান। সৎ ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত এই মেয়র প্রার্থীর পরাজয় অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে যা বেরিয়ে এসেছে মোদ্দা কথায় তা হলো- আওয়ামী লীগের একাংশের অসহযোগিতা আর প্রতারণার বলি হয়েছেন নৌকার এই প্রার্থী।
দলীয় কোন্দল, দল থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মেয়র (বরখাস্ত) জাহাঙ্গীর আলমের বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক, গাজীপুর মহানগরে আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকা, কেন্দ্রীয় প্রচার প্রতিনিধি দলের কার্যকর ভূমিকা না থাকা, নৌকার এজেন্ট সেজে প্রতারণা- এসব কারণে আজমত হেরে গেছেন বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।
আজমত উল্লা খানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, মূলত নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই হেরেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। পাশাপাশি জাহাঙ্গীরের অবৈধ টাকা এবং এর সুবিধাভোগীদের দলীয় প্রার্থীকে অসহযোগিতার কারণে ভোটে ইতিবাচক ফল আসেনি।
তিনি বলেন, গাছা ও টঙ্গী এলাকাকে গাজীপুরে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ গাছাতেই হেরে গেছেন আজমত। পাশাপাশি গাজীপুর মহিলা লীগের সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকীর এলাকা কালীগঞ্জেও হেরেছেন দলীয় প্রার্থী।
উদাহরণ তুলে ধরে তিনি জানান, গাছায় মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে নৌকা পেয়েছে ২২ হাজার ৭৮৩। সেখানে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী পেয়েছেন ৩৮ হাজার ৪৫৫। একইভাবে সদরে নৌকা ২১ হাজার ৫৪৭ ভোট পেয়েছে। এর বিপরীতে টেবিল ঘড়িতে গেছে ৪১ হাজার ৯৭৭ ভোট। এই দুই এলাকার সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ দলীয় এবং ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। কালীগঞ্জে নৌকা পেয়েছে ১৫ হাজার ৫০৪ ভোট। আর টেবিল ঘড়ি পেয়েছে ২০ হাজার ১৪৩ ভোট।
গাজীপুরের সন্তান প্রভাবশালী ওই নেতা বলেন, ‘এই জেলায় আওয়ামী লীগে চারটি ভাগ। একটি স্বয়ং আজমত উল্লা খান। আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের। অপরটি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের এবং একটি সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের।
‘এ নির্বাচনে আজমত উল্লা ও মোজাম্মেল হকের অংশ কাজ করলেও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর অংশ যে সঠিকভাবে কাজ করেনি তা ভোটের অংকেই প্রমাণিত। আর জাহাঙ্গীরের কথা বলাই বাহুল্য।’
প্রসঙ্গত, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সাবেক মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন টেবিল ঘড়ি প্রতীকে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান নৌকা প্রতীকে পান ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। সে হিসাবে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে জায়েদা খাতুন মেয়র নির্বাচিত হন।
জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তবে তিনি এখন দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কৃত।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও আজমত উল্লা খানের নির্বাচনী কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ওসমান আলী বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের তেমন এজেন্ট ছিল না। জাহাঙ্গীর আলমের কর্মী-সমর্থকরা নৌকার ব্যাজ গলায় ঝুলিয়ে টেবিল ঘড়ির পক্ষে কাজ করেছেন।
‘দৃশ্যত তারা ছিলেন নৌকার কর্মী। কিন্ত কাজ করেছেন জায়েদা খাতুনের পক্ষে। আর এটা হয়েছে এ কারণে যে তারা জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে সুবিধাভোগী। সেটা মেয়র থাকাকালীন এবং ব্যবসাগত কারণে। অনেকে নৌকার ব্যাজ পরে কেন্দ্রে গোপনে জাহাঙ্গীরের এজেন্টের কাজ করেছেন। আসলে সমস্যা শুধু নেতাকর্মীরাই নয়, সমস্যা জাহাঙ্গীরের অনেক টাকাও। টাকায় ভোট কিনে নিয়েছেন তিনি।’
ওসমান আলীর এ বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায় আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিচালনা টিমের অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের বক্তব্য। তিনি বলেন, ‘বড় কারণ দলের বিরাট অংশ আমাদের প্রার্থীকে ভোট দেয়নি। আর একটি কারণ হলো বিএনপির পুরো ভোটই বিজয়ী প্রার্থী পেয়েছেন।’
সাবেক কাউন্সিলর ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা নিউজবাংলাকে জানান, বাহ্যিকভাবে অনেক কেন্দ্রে টেবিল ঘড়ির এজেন্ট ছিলো না। তবে বাস্তবে ওইসব কেন্দ্রে নৌকারই এজেন্ট ছিলো না। কেননা নৌকার এজেন্ট সেজে অনেকেই টেবিল ঘড়ির পক্ষে কাজ করেছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল এক নেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা সর্বজনবিদিত যে জাহাঙ্গীর যতটা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন তার চেয়েও বেশি সম্পর্ক রাখতে জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গে। এবার সেসব ভোট তার মা পেয়েছেন। সেসঙ্গে বিএনপির প্রার্থী না থাকায় তাদের ভোটও সব পেয়েছেন তিনি।
‘গাজীপুরে কাজ করতে গিয়ে মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সমন্বয়ের অভাব শেষ পর্যন্ত দূর করা সম্ভব হয়নি।’