গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচারণার শেষ দিনে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন ও সরকার শাহনুর ইসলাম রনি।
মঙ্গলবার সকালে টঙ্গীর নিজ বাসভবনে নাগরিকসেবা সহজ ও জনবান্ধব করে পরিচ্ছন্ন সবুজ নগরী গড়তে ১৯ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেন রনি।
অন্যদিকে দুপুরে নগরীর ছয়দানায় নিজ বাসভবনে আগামী পাঁচ বছরের জন্য হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফের ঘোষণা দিয়ে ৯ দফা ইশতেহার দেন জায়েদা খাতুন।
জায়েদা খাতুনের ৯ দফা
নির্বাচিত হলে সাধারণ মানুষের বাড়িঘরের আগামী পাঁচ বছরের হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফের কথা জানিয়ে ৯ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। এ সময় তার ছেলে সাবেক মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম উপস্থিত ছিলেন। জাহাঙ্গীর আলম তার মায়ের পক্ষে ইশতেহারটি পাঠ করে শোনান।
নির্বাচনী ইশতেহারে জায়েদা খাতুন বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে সাধারণ মানুষের বাড়িঘরের আগামী পাঁচ বছরের হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করা হবে। আমার ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের পরিকল্পনা ও প্রণীত মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী তার অসমাপ্ত কাজ সম্পাদন করব। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডে রাস্তা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন করব।
‘প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রয়োজন অনুযায়ী এবং প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি চলাচল উপযোগী রাস্তা নির্মাণ করব। সমগ্র গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় রাজেন্দ্রপুর থেকে শুরু করে টঙ্গী আর আশুলিয়া হয়ে কোনাবাড়ি কাশিমপুর কাউলতিয়াকে সংযুক্ত করে আউটার রিংরোড নির্মাণের মাধ্যমে যানজট সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হবে।
‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত সংযোগ ব্রিজ নির্মাণ করব। যাতায়াতের জন্য একাধিক বিকল্প রাস্তা এবং ব্রিজ নির্মাণ করব।’
ইশতেহারে জায়েদা খাতুন বলেন, ‘গাজীপুরকে একটি আধুনিক স্মার্ট, ক্লিন এবং গ্রিন সিটি হিসেবে গড়ে তুলব। হোল্ডিং অনুযায়ী বিভিন্ন সেবা ডিজিটালাইজ করার লক্ষ্যে ডিজিটাল হোল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বাস্তবায়ন করব এবং স্মার্ট হোল্ডিং কার্ড দেব। এতে নাগরিক অনলাইনের মাধ্যমে ঘরে বসে হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে পারবেন।
সিটিতে ই-ট্রেড লাইসেন্স চালু করব। এতে নাগরিকরা অনলাইনে লাইসেন্সের আবেদন এবং নবায়ন করতে পারবেন। যেদিন আবেদন করা হবে সেদিনই লাইসেন্স ইস্যু হবে। সিটি করপোরেশনের সেবা সহজতর করার জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার চালু করা হবে।
‘আমি নির্বাচিত হলে সিটি করপোরেশন এলাকায় কর্মরত শ্রমিকদের তথ্য নিয়ে একটি ডিজিটাল ডাটাবেজ প্রণয়ন করব। এতে শ্রমিকদের বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ থাকবে। শ্রমিকদের সুচিকিৎসার জন্য সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন করা হবে। সেখানে নামমাত্র মূল্যে শ্রমিকদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হবে। শ্রমিক স্বার্থরক্ষায় ট্রেড ইউনিয়ন চালু করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করব এবং মাদকের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে। মাদক নির্মূলে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
‘ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ডের বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে ওয়ার্ডভিত্তিক উন্নয়ন ও সন্ত্রাস বিরোধী নাগরিক কমিটি গঠন করা হবে। মদ-জুয়া ও মাদক প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। মাতাল, জুয়াড়ি ও ভবঘুরেদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
‘সিটি করপোরেশনের প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নাগরিকদের স্যার সম্বোধন করবেন এবং প্রকৃত অর্থে সেবার মানসিকতা নিয়ে নাগরিকদের সেবা দিতে হবে। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর, সচিবসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। সিটি করপোরেশনের বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা হবে। ক্রেতা-ভোক্তা ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
জাহাঙ্গীরের মা বলেন, ‘ক্লিন সিটি, গ্রিন সিটি বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশন এলাকা জুড়ে পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ করা হবে। অসহায় মহিলাদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠায় এককালীন পুঁজি অনুদান হিসেবে দেয়া হবে।
‘দুস্থ ও অসহায় নারীদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্রে বিশেষ প্রণোদনা ঋণ দেয়া হবে। বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পার্টটাইম কাজের ব্যবস্থা করা হবে।’
সরকার শাহনুর ইসলাম রনির ইশতেহার
নির্বাচিত হলে গাজীপুর সিটিকে জনবান্ধব, শিল্পবান্ধব, যানজটমুক্ত, পরিবেশবান্ধব, জলাবদ্ধতামুক্ত, সুপরিকল্পিত আবাসনের নগরী হিসেবে গড়ার কথা ইশতেহারে তুলে ধরেছেন রনি।
বিএনপি পরিবারের সদস্য এই প্রার্থী ইশতেহারে গাজীপুরের উন্নয়নে তার বাবা নূরুল ইসলাম সরকার ও চাচা হাসান উদ্দিন সরকারের বিভিন্ন ভূমিকা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবার অত্র এলাকার উন্নয়নের গোড়াপত্তন করে। আমি পারিবারিক ঐহিত্য ও অভিজ্ঞতাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চাই। নগর পিতা নয়, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একজন সেবক হয়ে নাগরিকদের সুখ-দুঃখে পাশে থাকতে চাই।’
১৯ দফা ইশতেহারের শুরুতেই রনি নির্বাচিত হলে গাজীপুর সিটিকে একটি পরিচ্ছন্ন সবুজ নগরী হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। একইসঙ্গে সিটি করপোরেশনের সব নাগরিকসেবা সহজ ও জনবান্ধব করার ঘোষণা দেন।
গাজীপুরে শিল্পবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলবেন জানিয়ে ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘অতিরিক্ত করারোপের ফলে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান সিটির বাইরে অন্যত্র চলে গেছে এবং যাচ্ছে। যেসব নাগরিক বাড়ি/কলোনি ভাড়ার আয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতেন তারা এখন দৈন্যদশায় পড়েছেন।
‘নির্বাচিত হলে শিল্প-ট্যাক্স সহনীয় মাত্রায় নির্ধারণ করব এবং শিল্পের সব সমস্যা চিহ্নিত করে একটি শিল্প ও শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলব। বিশেষ করে টঙ্গী ও কোনাবাড়ি বিসিক এবং টঙ্গীতে রাজউকের নির্ধারিত শিল্প জোনে এখনও যেসব প্লট পতিত/পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে সেসব স্থানে শিল্প ইউনিট স্থাপনের জন্য শিল্প্যোদ্যোক্তাদের আগ্রহী করার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।’
এছাড়া যেসব কারখানা বন্ধ বা রুগ্ন অবস্থায় রয়েছে সেসব কারখানার মালিকদের যথাসাধ্য সহযোগিতা দিয়ে কারখানাগুলো সচলে চেষ্টা করার কথা বলা হয়েছে ইশতেহারে। যাতে নগরবাসীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এবং শিল্প মালিক ও বাড়ি মালিকরা ভালো থাকেন।
বিকল্প রাস্তা সম্প্রসারণ-উন্নয়ন ঘটিয়ে ঢাকা-গাজীপুর যানজটমুক্ত যাতায়াতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা হবে জানিয়ে ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘গাজীপুর শহরের সঙ্গে ঢাকার সহজ যোগাযোগের জন্য বনমালা রোড থেকে রেললাইনের পূর্বপাশ দিয়ে তুরাগ নদ পর্যন্ত রাস্তাটি সম্প্রসারণ করব এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত সম্প্রসারণ করব।’
গাজীপুর শহরকে এক রাস্তার শহর বলা হয়। তাই নগরীর পূর্ব-পশ্চিমমুখী দুটি রাস্তা নির্মাণ করার ঘোষণা দিয়ে ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচিত হলে জয়দেবপুর জংশনের দক্ষিণ পাশ এবং উত্তর পাশ দিয়ে আরও দুটি রাস্তা পূর্ব-পশ্চিমমুখী করে নির্মাণের উদ্যোগ নেব। রাস্তা নির্মাণ/প্রশস্তকরণে ভূমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে।’
এ ছাড়া মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ততম রাস্তাগুলোর রেলক্রসিংগুলোর উপর প্রয়োজন অনুসারে ওভারপাস নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে ইশতেহারে।
একইসঙ্গে নাওজোর থেকে কাশিমপুর হয়ে জিরানী পর্যন্ত এবং গাজীপুর টু পূবাইল রোডের কাজ দ্রুত শেষ করবেন বলে ইশতেহারে জানিয়েছেন রনি।
আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত স্কুল-কলেজ গড়ে তোলার কথা জানিয়ে ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচিত হলে ৫৭টি ওয়ার্ডে সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ৫৭টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণ করা হবে।’
ইশতেহারে শিশুদের সুস্থ বিনোদন ও খেলাধুলার জন্য ৫৭টি সুপরিসর খেলার মাঠ এবং ৫৭টি ওয়ার্ডে ৫৭টি শিশুপার্ক ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের কথাও বলা হয়েছে।
পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলে বায়ু ও পানিদূষণ সর্বনিম্ন মাত্রায় নামিয়ে আনার চেষ্টা করবেন বলে ইশতেহারে অঙ্গীকার করেছেন রনি।
এলাকাভিত্তিক জলাবদ্ধতা দূরীকরণে স্থানীয় জনগণ এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে জানিয়ে ইশতেহারে তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমের আগেই ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হবে। ড্রেন পরিষ্কারে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির বাহন আনা হবে।
ইশতেহারে গার্মেন্ট শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের জন্য সুপরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন রনি। একইসঙ্গে বস্তিগুলোকে উন্নত সুযোগ-সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে।
ইশতেহারে মাদক, সন্ত্রাস, ইভটিজিংমুক্ত নগরী গড়ে তোলারও অঙ্গীকার করেছেন তিনি। একইসঙ্গে চেষ্টা করবেন ‘কিশোর গ্যাং’ দমন ও বিপদগামী কিশোরদের সংশোধনের আওতায় আনার।
সবশেষে ভোটকে নাগরিকদের শ্রেষ্ঠ আমানত উল্লেখ করে রনি বলেন, ‘আমি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। যদি আমাকে আপনাদের যোগ্য মনে হয়, ২৫ মে ভোটের মাধ্যমে আপনাদের আমানতের সেরা বিনিয়োগ করুন। আমি আপনাদের পাশে সেবক হয়ে থাকব, ইনশাআল্লাহ।’