বৈশাখ শেষে জ্যৈষ্ঠ মাসেও গ্রীষ্মের খরতাপে পুড়ছে কুমিল্লা। গত কয়েক দিনে কুমিল্লায় তাপমাত্রার রেকর্ড হয়। জেলায় দেখা মিলছে না বৃষ্টির।
এমন পরিস্থিতিতে কুমিল্লার অনেক জলাশয় প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশীয় প্রজাতির অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশকর্মীসহ সংশ্লিষ্টরা।
জেলে ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুমিল্লার জলাশয়গুলোতে সাম্প্রতিক বছরে চাপিলা, বইচা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, বাইলা, মেনি, শিং, কই, টাকি, তেলা টাকি, মলা, ঢেলা, দারকিনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছের দেখা কম মিলছে।
জেলার সবচেয়ে বেশি দেশীয় মাছ বিচরণের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে চান্দিনা, দাউদকান্দি, হোমনা, মেঘনা, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জের জলাশয়গুলো। এসব এলাকার জলাধারগুলো এখন প্রায় পানিশূন্য। মেঘনা, তিতাস, গোমতী, কালাডুমুর, ডাকাতিয়া, ঘুঙুর নদীতে পানি নেই বললেই চলে।
বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বছর দশেক আগেও বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে আমরা রাজাপুর জলায় পুঁটি, টাকি, বাইম, গুতুম, শোল, বোয়াল, কালিবাউশ মাছ ধরতাম। সবচেয়ে বেশি ছিল টেংরা, কই, পুঁটি। এখন পানি হয় না। মাছও ধরতে পারি না।’
উপজেলার পয়াত গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী হামিদ মিয়া বলেন, ‘পয়াতের জলায় ইছা (ছোট চিংড়ি) মাছ ছিল। আস্তা বা চাঁই দিয়া ইছা মাছ ধইরা বাজারে নিতাম।
‘আইজ কত বছর ইছা মাছ দেহি না। বৈশাখ মাসেও আমরা আন্তা লইয়া চলাত পইড়া থাকতাম। এহন পানি নাই। মাছও নাই।’
স্থানীয় পরিবেশকর্মীদের সংগঠক মতিন সৈকত বলেন, ‘পানির অভাব, কীটনাশকের প্রয়োগ, অপরিকল্পিতভাবে জলাশয়ে বাঁধ দেয়াসহ আরও নানা কারণে দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে। আমরা শৈশব-কৈশোরে যেসব মাছ দেখেছি, এখন সেগুলো নেই। যে পরিমাণে দেশীয় মাছ দেখেছি, বর্তমানে তা অপ্রতুল।
‘দেশীয় মাছের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। দেশীয় মাছ রক্ষায় সরকারের পরিকল্পনা করা এখন সময়ের দাবি।’
কুমিল্লা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. রবিউল আলম পারভেজ বলেন, ‘শুধু যে অপ্রতুল বৃষ্টির কারণে দেশীয় মাছ বিপন্ন বা বিলুপ্ত হচ্ছে, তাই না; আরও বহু কারণ রয়েছে, তবে আমরা কৃত্রিম পদ্ধতিতে অনেক দেশীয় মাছ ফিরিয়ে এনেছি। সেসব দেশি মাছ এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে, তবে আমাদের চারপাশের জলাশয়ে দেশীয় মাছের প্রজনন বৃদ্ধির জন্য পানির গভীরতা ও জলাশয় সংস্কার করতে হবে।
‘নদীদূষণ ও কলকারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলা যাবে না। মাছের আবাসস্থল সংরক্ষণ করতে হবে। মাছের অভয়াশ্রম করতে হবে। নির্ধারিত সময়ে ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ ধরা নিষেধ করতে হবে। তাহলেই আগের মতো দেশীয় মাছের বিচরণ ঘটবে।’
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অমিতাভ কুমার বাড়ৈ বলেন, ‘দেশীয় মাছ, শামুক-ঝিনুক নিয়ে আমরা গবেষণা করেছি। আমরা দেখেছি শুধু পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত নয়, নদীশাসন, নদীদূষণ খাল-বিল ভরাট, কীটনাশক ব্যবহার, লাগামহীন মাছ শিকার, মাছের প্রজজন ক্ষেত্র নষ্ট করা, পোনা মাছ শিকার করার জন্যই গেল ১০ বছরে আমাদের বেশির ভাগ দেশীয় মাছ বিপন্ন হয়ে গেছে।
‘এ ক্ষেত্রে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। যেসব সমস্যা দেশীয় মাছের বংশবৃদ্ধিতে অন্তরায়, সেসব সমস্যা সমাধান করলে হয়তো আমাদের খাল-বিল, জলাশয়ে আবারও দেশীয় মাছের বিচরণ ঘটবে।’