বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সিন্ডিকেটের দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ

  •    
  • ১৬ মে, ২০২৩ ২০:৫০

বাইগামের নবনিযুক্ত প্রশাসক ড. মো. মোকতার হোসেন বলেন, ‘অপ্রয়োজনে অসংখ্য নিয়োগ, এফডিআর ভেঙে ৫ কোটি টাকা তসরুপ, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন নির্মানে দুর্নীতি, কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিং কেনায় অনিয়ম, সমান্য একটা বনভোজনে ৪৩ লাখ টাকা ব্যয় এবং হোটেল ইজারার ঘটনাগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পেয়েছি। আরও নানা অনিয়ম রয়েছে, যা তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।’

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধিভুক্ত ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের (বাইগাম) রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে অনিয়ম আর দুর্নীতি। অপ্রয়োজনীয় নিয়োগ, কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্য, ব্যক্তিগত কাজে প্রতিষ্ঠানের সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, অযাচিত ব্যয়- এমন নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানটিতে এতো সব অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ফলে তিন মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রশাসক।

বাইগামে সিন্ডিকেটের তিন সদস্য (বাঁ থেকে)- উপ-পরিচালক বদরুল আহসান, সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সরকার সুমন। ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি আব্দুল মান্নান ও মহাসচিব আমির হোসেন মোল্লাকে সামনে রেখে বাইগামের উপ-পরিচালক বদরুল আহসান, সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সরকার সুমনের সীমাহীন দুর্নীতি আর অনিয়েমেই বাইগাম-এর আজ এই অবস্থা। তাদের কারণেই তিন মাস ধরে তারা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। পরিবার নিয়ে দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে।

বাইগামের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস খান বলেন, ‘এখানে দুর্নীতির শেষ নেই। গত কমিটির সভাপতি-মহাসচিবের ছত্রছায়ায় বাইগামের তিন কর্মকর্তা দুর্নীতির একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তারাই সব অপকর্মের হোতা।

‘এই সিন্ডিকেটই নিয়মবর্হিভূতভাবে বাইগামের ১১ কোটি টাকার বেশি এফডিআর ভেঙে তা থেকে ৪ কোটি টাকা তসরুপ করেছে। ওই এফডিআর করা হয়েছিল প্রবীণদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য। তাদের বিপদে-আপদে সাহায্য করার জন্য। অথচ ওই এফডিআরের টাকা দিয়ে পিকনিক, অফিসের বিভিন্ন দিবসের অনুষ্ঠান পালনের নামে অর্ধেকটাই গায়েব করা হয়েছে।’

দীর্ঘদিন ধরে বাইগামে এতো সব অনিয়ম-দুর্নীতি চললেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি সমাজসেবা অধিদপ্তর। দুর্নীতি মহামারি আকার ধারণ করার পর টনক নড়ে তাদের। গঠন করা হয় ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি।

তদন্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত করতে গিয়ে দেখি এখানে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে অনিয়ম হয়নি। এই প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে পরিচালনা করা হতো।

‘ইতোমধ্যে আমাদের তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে বাইগামের বর্তমান প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আমরা যা যা পেয়েছি তার সবই প্রতিবেদনে তুলে ধরেছি।’

বিনা প্রয়োজনে ৬৮ জনের নিয়োগ

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, গত তিন বছরে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও কেবল নিয়োগ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে (বাইগাম) নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৬৮ জনকে। আর এসব নিয়োগের মাধ্যেমে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা।

নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন ৯ জন চিকিৎসক, ৯ জন নার্স এবং বাকি ৫০ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। এর মধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছে ১১ জনের। বাকিদের নিয়োগ হয়েছে নিয়মবর্হিভূতভাবে। আর এই ৬৮ জনকে নিয়োগ দেয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে বেতন-ভাতা বাবদ গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ২২ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে নিম্নমান সহকারী হিসেবে কর্মরত এবিএম জাকারিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এই হাসপাতালে এমনিতেই কম রোগী আসে। আর প্রবীণ নিবাসও থাকে নিরিবিলি। আমাদের আগের কর্মচারী দিয়েই ভালোভাবে কাজকর্ম চলছিল। তারপরও এখানে প্রায় ৬৮ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখন এইখানে রোগী আর প্রবীণদের চেয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। এখন ওই অতিরিক্ত জনবলের কারণে আমরা ৩ মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না।

দিনের বেশিরভাগ সময়ই রোগী না থাকায় সুনসান হাসপাতাল। অথচ অপ্রয়োজনে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৬৮ জনকে। ছবি: নিউজবাংলা

প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস খান বলেন, ‘মূলত টাকা খাওয়া জন্য সিন্ডিকেট এসব অবৈধ নিয়োগের ব্যবস্থা করে। এই নিয়োগের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু সরকারের কোন জায়গা থেকেই এই নিয়োগের অনুমতি নেয়া হয়নি। প্রতিটি পদের বিপরীতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা খেয়ে তারা নিয়োগ দিয়েছে। আর কিছু পদে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দিয়েছে।’

বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন স্থাপনে দুর্নীতি

বাইগামের বৈদ্যুতিক ব্যাবস্থা উন্নত করতে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে একটি এক হাজার কেভি সাব-স্টেশন নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে সর্বনিন্ম দরদাতাকে কাজ না দিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা এ আর পাওয়ারটেক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড কম্পানিকে ৭২ লাখ টাকায় কাজ দেয়া হয়।

বাইগামের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই কাজে প্রথমেই দুর্নীতি করা হয় সর্ব্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে। এর পরে হয় মহা দুর্নীতি। কাজ পাওয়া কোম্পানিটি কাজ শুরুর এক পর্যায়ে জানায় যে সাব-স্টেশনটি ১ হাজার কেভি হবে না, ৮০০ কেভি হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৭৫ শতাংশ বিল দেয়ার পর জানা গেল সাব-স্টেশনটি আসলে ৪০০ কেভির। এছাড়া দরপত্রে এই স্টেশনের সঙ্গে সোলার প্যানেল দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। বুয়েটের মাধ্যমে সার্টিফায়েড হওয়ার শর্তও পূরণ হয়নি।

তিনি বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই অনিয়ম করার সাহস পেয়েছে আমাদের এখানকার তিন কর্মকর্তার সিন্ডিকেটের সহায়তায়। এই তিনজন হলেন উপ-পরিচালক বদরুল আহসান, সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম এবং সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সরকার সুমন। এরাই কারসাজি করে কমিশন খেয়ে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এনেছে। আর পরিচালনা কমিটিকে নানা বুঝ দিয়ে তা পাস করিয়ে নিয়েছে।’

কিডনি ডায়ালাসিস মেশিন কেনায় অনিয়ম

তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, গত অথর্বছরে প্রবীণ হাসপাতালের জন্য কেনা হয় ৫টি কিডনি ডায়ালাসিস মেশিন। এখানেও সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে ৬৬ লাখ টাকায় মেশিন সরবরাহের কাজ দেয়া হয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যে ডায়ালাসিস মেশিন সরবরাহ করেছে সেটি ২০১৮ সালের পুরনো মডেলের। অথচ শর্ত ছিল আধুনিক আপডেটেড মেশিন সরবরাহ করতে হবে।

এ বিষয়ে ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের চাকরি থাকবে না। সমস্যা তো শুধু কেনাকাটায় না, পরিচালনায়ও আছে। ৫টি ডায়ালাইসিস মেশিন কেনা হলেও হাসপাতালে কোনো আইসিইউ-এসডিইউ নেই। তাই এই মেশিন প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

‘ডায়ালাইসিস করার পর অনেক সময় আইসিইউ জরুরি হয়ে পড়তে পারে। আইসিইউ না থাকলে অনেক সময় রোগী মারাও যেতে পারে। তাই আমরা ডায়ালাসিস মেশিন আইসিইউর অভাবে বেশিরভাগ সময় ব্যবহার করি না। এগুলো আসলে পরিকল্পনা করে কেনা হয়নি। কমিশন বাণিজ্য করার জন্য কেনা হয়েছে।’

এক বনভোজনেই খরচ ৪৩ লাখ টাকা

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিষ্ঠানের প্রবীণ সদস্যদের চাঁদার অর্থে প্রায় ১২ কোটি ৫০ লাখ এবং ৭০ লাখ টাকার দুটি এফডিআর ছিল। তা প্রবীণদের কল্যাণে ব্যয় করার কথা ছিলো। কিন্তু দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট সেই এইফডিআর থেকে ৪ কোটি টাকার বেশি নিজেদের আমোদ-প্রমোদে ব্যয় করেছে।

চলতি বছর এফডিআররের ৪৩ লাখ টাকায় করা হয় বনভোজন। এছাড়া বিভিন্ন দিবস পালন, উৎসবের নামেও খরচ করা হয় এই টাকা। মূলত এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাইগামের তহবিল বন্ধ করে দেয়।

স্বজনদের নিয়োগ দিতে হিসাব সফটওয়্যার স্থাপন

প্রতিষ্ঠানটির হিসাব ঠিক রাখার জন্য ৩ লাখ টাকা মূল্যের সফটওয়ার ৭ লাখ টাকায় কেনার অভিযোগ করেছেন হাসপাতালের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়, এই সফটওয়‍্যার পরিচালনার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই সফটওয়ার অনেক কোম্পানিই মাত্র ৩ লাখ টাকায় করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কমিশন খেয়ে নামসর্বস্ব এক কোম্পানির কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা তা কেনা হয়।

‘সফটওয়্যার স্থাপনের পর তা পরিচালনার নামে নতুন নিয়োগ দিতে উঠেপড়ে লাগেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। অথচ ওই সফটওয়্যার আমাদের পুরনো লোকেরাই চালাতে সক্ষম। বাস্তবতা হলো, সফটওয়্যার কেনা ও নতুন লোক নিয়োগ দেয়ার পরও হাসপাতাল চলছে সেই ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে।’

বাইগামের সামনে স্থাপিত এই হোটেল ইজারা নিয়েও হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। ছবি: নিউজবাংলা

হাসপাতালের সামনে হোটেল বসিয়ে ৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ

আগারগাঁওয়ে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সামনে একটি হোটেল স্থাপনের অনুমতি দেয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ। তিন বছরের জন্য ১৫ লাখ টাকায় এটি ইজারা নেন সুলতান কিচেন নামের হোটেলের মালিক নাসির উদ্দিন। তিনি প্রবীণ সংঘের অফিসে ১৫ লাখ টাকা জামা দিলেও পরে জানতে পারেন যে জমা হয়েছে ১০ লাখ টাকা।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কী একটা বিপদে যে পড়ছি বলে বোঝাতে পারবো না ভাই। আমি নিজ হাতে ১৫ লাখ টাকা অফিসে জমা দিয়ে আসছি। অথচ পরে শুনি জমা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। বাকি ৫ লাখ টাকা নাকি জমাই হয়নি। তারা টাকা খেয়ে ফেলেছে। এখন বলছে আমাকে আরও ৫ লাখ টাকা দিতে হবে।’

কারা টাকা খেয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এই অফিসের সবাই জানে যে টাকা কে বা কারা খাইছে। তবে আমি তাদের নাম বলতে পারব না। আমাকে তো এখানেই ব্যবসা করতে হবে, তাই না!’

বন্ধ হওয়ার উপক্রম প্রবীণ নিবাস

বাইগাম কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়ায় আমাদের প্রবীণ নিবাসও বন্ধ হওয়ার পথে। কারণ এই প্রতিষ্ঠান চলে এখানে থাকা প্রবীণদের দেয়া কিছু টাকা আর প্রবীণ সংঘের ভর্তুকির টাকায়।

বর্তমানে এখানে ৩৬ জন প্রবীণ থাকেন। সেখান থেকে মাসে আয় হয় দেড় লাখ টাকা। আর মাসে খরচ হয় ৭-৮ লাখ টাকা। তাছাড়া ৩ মাস আমাদের বেতন না হওয়ায় ডাক্তাররাও আর আগের মতো এখানে রোগী দেখেন না। তাই হাসপাতালে আর আগের মতো রোগী নেই। এখন হাসপাতালের বেডে রোগী আছে ৫-৬ জন। তাই প্রতিষ্ঠানের আয়ও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বরাদ্দ না পেলে প্রবীণ নিবাসই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাইগামের একাধিক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের উপ পরিচালক বদরুল আহসান এখন এলপিআর-এ আছেন। নিয়ম অনুযায়ী তিনি অফিস না করেও বেতন-ভাতা পাবেন। অথচ শুধু দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি এখনও নিয়মিত অফিস করে যাচ্ছেন।

‘দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা ইতোমধ্যে তিনি তার বেশ কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকে বাইগামে চাকরি দিয়েছেন। সঙ্গে অন্যান্য পদে নিয়োগ বাণিজ্য তো আছেই। তারই নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটিতে গড়ে উঠেছে দুর্নীতির এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের অপর দুই প্রভাবশালী সদস্য হলেন- বাইগামের সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সরকার সুমন।’

তারা জানান, সিন্ডিকেট সদস্য এই সহকারী পরিচালক মাসুম প্রতিষ্ঠানটিতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগদান করলেও উপ-পরিচালক বদরুল আহসানের সহযোগিতায় হয়ে যান প্রশাসনিক বিভাগের সহকারী পরিচালক। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাইগামে নিয়োগ দিয়েছেন তার বেশ কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকে। বাইগামের সব দুর্নীতিতেই রয়েছে তার হাত। অফিসে নারী কর্মীদের যৌন হয়রানির অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছেন বর্তমান প্রশাসক।

প্রবীণ হাসপাতালের পাশেই প্রবীণ নিবাস। ছবি: নিউজবাংলা

অ্যাম্বুলেন্স ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার: আয় ৭ হাজার, ব্যয় ৮ লাখ

বাইগামের কর্মকর্তারা জানান, হাসপাতালে বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ছিল। তবে তিন বছর ধরে রয়েছে মাত্র একটি। এই তিন বছরে অ্যাম্বুলেন্স থেকে হাসপাতালের আয় হয়েছে ৭ হাজার টাকা। অথচ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮ লাখ টাকা।

কারণ হিসেবে বাইগামের কর্মকর্তরা বলছেন, সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সুমন বাইগামের পরিবহন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকাকালে অ্যাম্বুলেন্সটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। মূলত সে কারণে অ্যাম্বুলেন্সের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়েছে। এছাড়া সিন্ডিকেটের সদস্য হওয়ায় বাইগামের আরও অনেক অপকর্মের সঙ্গে তার নাম রয়েছে। তদন্ত কমিটিও তার ব্যাপারে নানা অনিয়মের তথ্য পেয়েছে।

সিন্ডিকেটের এই প্রভাবশালী সদস্য পুরো প্রতিষ্ঠানেই ধরাকে সরাজ্ঞান করে চলেন। নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতি করে চললেও তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কিছু বলার সাহস পান না। কিছু বলতে গেলেই তিনি মারমুখী হয়ে ওঠেন। সুমনের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের ভিডিও ফুটেজও নিউজবাংলার হাতে এসেছে।

প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস খান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় বছরে ৮ থেকে ৯ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে হাসপাতাল আর প্রবীণ নিবাস ও অন্যান্য খাত থেকে ৩-৪ কোটি টাকা ইনকাম হয়। বাদবাকি ৫ কোটি টাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্ধ দেওয়া হয়। এখন এসব দুর্নীতির কারণে মন্ত্রণালয় বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে।

‘এসব দুর্নীতি তদন্ত করতে ৪ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সহকারী পরিচালক মাসুমকে তার পদ থেকে সরিয়ে হাসপাতালের ফার্মেসির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আর সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা সুমনকে বসানো হয়েছে হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারে। আশা করি সঠিক তদন্ত করে এসব দুর্নীতিবাজকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’

সিন্ডিকেটের তিন কর্মকর্তার অভিযোগ অস্বীকার

এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাইগামের সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সরকার সুমন।

মাসুম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ দেয়া হয়েছে এবং তদন্ত প্রতিবেদনে কী আছে জানি না। তবে এগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগ।’

তাহলে আপনাকে নিজের পদ থেকে সরিয়ে হাসপাতালের ফার্মেসির দায়িত্বে দেয়া হলো কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুম বলেন, ‘আমি জানি না কেন আমাকে এতো নিম্ন পদে দেয়া হলো। আসলে চাকরি করতে গেলে কর্তৃপক্ষ যে পদে দেবে আমাকে তো সেই পদেই কাজ করতে হবে। এর বাইরে আমি কিছু জানি না।’

আব্দুর রহমান সরকার সুমনকে প্রশ্ন করলে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনার যা জানার সেটা আপনি আমাদের প্রশাসককে প্রশ্ন করেন। তিনিই সব উত্তর দেবেন।’

হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠান চলে একটি কমিটির মাধ্যমে। কমিটির বাইরে গিয়ে তো আমি একা একা কোনো কিছু ব্যবহার করতে পারি না। আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় বাইগামের উপ-পরিচালক বদরুল আহসানের সঙ্গে।

দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই অভিযোগ মিথ্যা। যারা এই কথা বলছে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলছে। একটা অফিস তিনজন দিয়ে চলে নাকি?’

আপনার বিরুদ্ধে বাইগামের কেনাকাটা ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ কেন আসছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। আর তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আমি এখনও দেখিনি। তাই এসব নিয়ে আমি কিছু বলব না।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে বদরুল আহসান বলেন, ‘এক্সিকিউটিভ কমিটি যে নির্দেশ দিয়েছে অফিসিয়াল প্রধান হয়ে কেবল সেটা বস্তাবায়ন করেছি। এই অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে আপনি আমাদের আগের কমিটির মহাসচিব আমির হোসেন মোল্লাকে প্রশ্ন করেন। তিনিই সব বলতে পারবেন।’

তবে আমির হোসেন মোল্লা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ যেন ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাই না প্রবাদের মতো। তারা অফিসিয়াল লোক, অফিসে কতজন নিয়োগ হবে, কী কী কেনাকাটা হবে সেসব তারাই তৈরি করে দিত। আমরা কমিটির নেতা হিসেবে সেগুলো পাস করে দিতাম। অফিসে সব কাগজপত্রই আছে। সেগুলো দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কারা এগুলো করেছে।’

নবনিযুক্ত প্রশাসক যা বললেন

বাইগামের নবনিযুক্ত প্রশাসক ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামজিক নিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব ড. মো. মোকতার হোসেন বলেন, জানুয়ারি মাসে ওরা বনভোজন করেছে ৪৩ লাখ টাকা খরচ করে। এখানে অনিয়মের গন্ধ পেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। তাই ৩ মাস ধরে বেতন বন্ধ রয়েছে। আমি এখন প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে তাদের বেতন দেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আয় কম হওয়ায় বেতন দিতে দেরি হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে সেটা দেখে বোঝা যায় এই প্রতিষ্ঠান (বাইগাম) চলতো ম্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে। যে যার মতো নিয়োগ নিতো, যোগ্যতা না থাকলেও নিয়োগ নিতো অনেক বেতনে। প্রয়োজন ছাড়া কেনাকাটাও করতো। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানের উপ-পরিচালক বদরুল আহসান নিজেকে উপ-সচিব পদমর্যদার দাবি করত। এবং তার যোগ্যতার চেয়েও অনেক বেশি বেতন নিতো।’

তদন্ত প্রতিবেদনে কী কী অনিয়ম পেলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অপ্রয়োজনে অসংখ্য নিয়োগ, এফডিআর ভেঙে ৪ কোটি টাকা তসরুপ, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন নির্মানে দুর্নীতি, কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিং কেনায় অনিয়ম, সমান্য একটা বনভোজনে ৪৩ লাখ টাকা ব্যয় এবং হোটেল ইজারার ঘটনাগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পেয়েছি। আরও নানা অনিয়ম রয়েছে, যা তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

‘মোট কথা, তৎকালীন কমিটির কয়েকজন আর বাইগামের কয়েকজন কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন এখন আমাদের হাতে। তারা সিন্ডিকেট করে এগুলো করতো বলে আমরা জানতে পেরেছি।

‘এখন আমি এই তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। মন্ত্রণালয় এই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবে।’

এ বিভাগের আরো খবর