রোববার দুপুর থেকে উপকূলজুড়ে চলে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র তান্ডবলীলা। ঝড়ের পর যতদূর চোখ যায়, চারিদিকে শুধু ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। বেশিরভাগ ঘর, দোকানপাট ও স্থাপনা উড়ে গেছে ঘূর্ণিঝড়ে।
প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে চলা ‘মোখা’র তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কক্সবাজারের অন্তত ১২ হাজার বসতঘর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ এলাকায়।
‘মোখা’র বিভিষিকাময় স্মৃতি নিয়ে নতুন এক ভোর শুরু করেছে ৬ বছরের শিশু আছমা আক্তার। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পর ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র কবলে পড়ে তাদের বসতঘর। ঝড়ের তাণ্ডবের পর বাড়ি ফিরে দেখে সবকিছুই শেষ।
সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে তাদের বাড়ি, যেখানে ছিল ছোট্ট আছমার পড়াশোনা, খেলনা, ঈদে কেনা শখের কাপড়। সব হারিয়ে নির্বাক চোখে সেই ঘরে খোঁজাখুজি করছে শিশু আছমা।
আছমার বাবা মোহাম্মদ হারুন পেশায় পানের দোকানদার। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ায় তাদের বসবাস।
আছমা বলে, ‘আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরেছি আজ। এসে দেখি আমাদের ঘরটি ভেঙেচুরে গেছে; হারিয়ে গেছে আমার সবকিছু। বই, খাতা, কাপড় সব শেষ। এখন নতুন করে কিভাবে কিনে দেবে বাবা!’
আশ্রয়কেন্দ্রেও খাবার মেলেনি জানিয়ে অভুক্ত আছমা বলে, ‘এখানে এসে বাবা দোকান থেকে চানাচুর আর ঝালমুড়ি এনে দিছে। তাই খেয়েছি।’
হারুন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত যখন তীব্র হচ্ছিল, স্ত্রী আর মেয়ে আছমাকে নিয়ে বেড়িবাঁধের পাড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠি। যে ভয়ে বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়েছি, সেখানেও ভয়ে ছিলাম। কারণ আশ্রয়কেন্দ্রটিও ঝুঁকিপূর্ণ। নাফ নদের জোয়ারের পানি আছড়ে পড়ে এই কেন্দ্রে। তখন কেঁপে উঠেছিল পুরো ভবন। তারপরও আল্লাহ রক্ষা করেছে।’
হতাশ হারুনের আক্ষেপ, ‘এখন নতুন করে কিভাবে শুরু করবো, বুঝতে পারছি না। সবকিছুই তো গেল। একেবারে নি:স্ব করে দিল!’
ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র তাণ্ডবের পর বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কটে ভুগছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা। ছবি: নিউজবাংলা
হারুনের মতো আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরছেন অনেকে। কিন্তু আগের পরিচিত সে বসতভিটা তাদের আর নেই। তাই অনেকে নেমে পড়েছেন নতুন করে জীবন শুরু করার যুদ্ধে। শুরু করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা মেরামতের কাজ।
শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা আবুল হাসেম। তিনি পেশায় একজন জেলে। বেড়িবাঁধের পাড়েই তার বসতঘর। ঝড়ের আগে পরিবারের ৭ সদস্য নিয়ে আশ্রয় নেন নিরাপদ স্থানে। সেখান থেকে ফিরে দেখেন ঘরে চালে টিন নেই; ঝড়ে উড়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘খাবার নেই; নেই বিশুদ্ধ পানি। ঘরেও পানি ঢুকেছে। তাই বাধ্য হয়ে লবণাক্ত পানি খেতে হচ্ছে। তেমন কোন সহযোগিতাও এখনো পাইনি। ইউপি মেম্বার বলেছে, তিনি কিছু ব্যবস্থা করবেন।’
উত্তরপাড়ার বাসিন্দা নামিজা বেগম বলেন, ‘ঝড়ের খবর পেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাই। যখন ঝড়ো বাতাস শুরু হয়, তখনই শুকনো কিছু কাপড় নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ঝড় থামার পর ফিরে এসে দেখি ঘর ভেঙেছে। খাবার-দাবার সব পানির নিচে। কিছুই ছিল না। উড়ে গেছে ঘরের বিভিন্ন অংশ।’
কক্সবাজারের বেশিরভাগ মানুষের উপার্জনের মাধ্যম লবণ চাষ, মাছ ধরা আর ফসল উৎপাদন। প্রায় ৬৬ হাজার একর জমিতে এবার গত ছয় দশকের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন শুরু হয়। তবে মৌসুমের শেষ সময়ে ঘূর্ণিঝড় এসে তাদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।
পানি ঢুকে পড়েছে বেশিরভাগ মাঠে। এছাড়াও পানের বরজ আর গ্রীষ্মকালীন ফসলি জমিতে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৫ শতাধিক বসতঘর।
এর মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ ও ত্রাণ বিতরণের কাজ শুরু করছে প্রশাসন।